২১.১.৮২
রফিক আজাদের লেখা চিঠি

রফিক আজাদের লেখা চিঠি

দিলা আমার,
বারবার তোমার চিঠি পড়ি, তোমার চিঠিতে ব্যক্ত কষ্ট (আর পরশু তো নিজের চোখেই তোমার অবস্থা দেখেছি) যে আমারও কষ্ট সেটুকু নিশ্চয়ই তোমাকে বোঝাতে হবে না।

কোনো কাজেই মন বসছে না, ছটফট করছি কেবল। আজ ‘রোববারে’ অনেক কাজ করার ছিলো, কিছুই করা হয়নি— এমনকি অন্যরাও আমাকে লক্ষ্য করেছে। এই রোগ চেপে রাখা যায় না, নিজের অজান্তেই জানান দিয়ে দেয় অন্যকে।

সমস্ত কাজ ফেলে ৭.৩০ (সন্ধ্যা) নাগাদ আমার সেই ভিসিআরওয়ালা বন্ধুর বাসায় চলে আসি। আমাকে দেখেই বন্ধুটি বললো, ‘তোমার শরীর খারাপ?’ ‘হুঁ’ ব’লে কাটাতে চেয়েও স্বাভাবিক হতে পারিনি সারাক্ষণ, ও বারবার জানতে চাইলো কি হয়েছে।

পরে কি আঁচ করেছে জানি না—আমাকে Drinks offer করলো, খাইনি। ইচ্ছে হলো না। Drowing Room-এ V.C.R.-এ ‘Kaalia’ ব’লে এক হিন্দে ছবি চলছে অমিতাভ বাচ্চনের—ভালো লাগেনি উঠে এসে বারান্দায় বসলাম, সঙ্গে-সঙ্গে সেও এসে বসলো, দুই বন্ধুতে কোনো কথা না-বলে ঘণ্টা খানেক সময় ব’সে রইলাম।

অতঃপর বাড়ি চ’লে আসি। বাচ্চাদের আদর ক’রে মন বসাতে চাই—হয় না। এখন রাত পৌনে একটা। বিদ্যুৎ চ’লে গেছে মোমের আলোয় তোমাকে লিখছি।

আমাকে সমূহ সর্বনাশের হাত থেকে বাঁচাতে গিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেলে উন্মোচিত হ’য়ে যে নিজেরই সর্বনাশ করলে, দিলা। তোমার সর্বনাশ তো আমারই সর্বনাশ সেটি কি বলার অপেক্ষা রাখে?

তুমি জানতে চেয়েছো, তোমার জানার বাইরেও আমার যে আরেকটি জগৎ আছে—এবং সইে জগতের সুখ-দুঃখ হাসি-কান্না। চাওয়াটা খুবই স্বাভাবিক, আমার আগেই জানানো উচিত ছিলো।

কিন্তু ঐ খবরটি জানানোর মতো গুরুত্ববহ ব’লে আমি মনে করিনি। আমার আটপৌরে, গার্হস্থ জীবন খুব শাদামাটা।

জগতের অন্য দশজন সাধারণ মানুষের মতোই একটা অচেনা অজানা মেয়েকে ১৯৬৯ সালের ১৩ই ডিসেম্বর বিয়ে করি। আমার আত্মীয়দের পছন্দ করা। আমিও আনুষ্ঠানিকভাবে দেখেছিলাম।

ঐসময় আমি একটি মফঃস্বল কলেজের মাস্টার—জীবন সম্পর্কে হতাশ এবং পদ্য লেখা ছেড়ে দিয়েছি তখন—এমনকি লেখালেখির অসারতা সম্পর্কে একটি দর্শনও দাঁড় করিয়েছিলাম। আমার মানসিক অবস্থা তখন পাগলামির গা-ঘেঁষে।

আমার স্ত্রী অনার্সসহ এম.এ। দুই কন্যা, দুই পুত্র সন্তানের জনক আমি। ইতিমধ্যে বিবাহিত জীবনের ১২ বছর  চ’লে গেছে। বারো বছর বড়ো দীর্ঘ সময়।

স্ত্রী মোটামুটি সহিষ্ণু—আমার বদভ্যাস, অনিয়মানুবর্তিতা, অমনোযোগিতা, কাণ্ডজ্ঞানহীনতা প্রভৃতি মেনে নিয়েই, হয়তো সন্তানদের মায়ায়ই প’ড়ে আছেন।

সংসারের সঙ্গে আমার সম্বন্ধ টাকা-পয়সার জোগান দেয়া এবং ঘরে ফিরে এসে রাত্রিযাপন করা। এক ধরনের মায়া, ভালোবাসা যে নেই, তা নয়। আছে। তবে ঐ পর্যন্তই। সন্তানদের আমি ভালোবাসি, পছন্দ করি। ওরাও করে।

দিলো, এখন তুমি বলো উপর্যুক্ত খবর সাতকাহন ক’রে বলার কি না। তাই আগ বাড়িয়ে তোমাকে কিছু জানাইনি। তাছাড়া, তোমার অজানা থাকারও কথা নয়।

দিলো, আমার হয়তো সবই আছে, কিন্তু আমি খুবই নিঃসঙ্গ—একলা মানুষ। আমি নিজেকে ঠিক বোঝাতে পারবো না—।তুমি লিখেছো আমার জীবনের মধ্যবিন্দুটি অধিকার ক’রে আছে পানশালার মতো মোহময় আকর্ষণ—।

পাগল, পানশালা কোনো আকর্ষণীয় স্থানই নয়, মোহময় তো নয়ই! পানীয় স্পর্শ না করতে তো আমাকে, স্ত্রী,পুত্র-কন্যা সকলেই বলে। তবু ছাড়িনি। তুমি যদি বলো তো ছেড়ে দিয়ে নামাজ-রোজা ধরবো। ও জিনিশ ছাড়া এমন কোনো কঠিন ব্যাপারই নয়।

তবে কে নিষেধ করছে সেটিই বড় কথা। সবার কথা শুনবো কেন? —আমার মা-ও তো না করেছেন বহুবার—শুনিনি। শুনবো কেন—আমার মা কি আমার ব্যক্তিগত বেদনার অংশীদার?

জন্ম দিয়েছেন ব’লেই কি আমার ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলাতে দেবো। ঐ অধিকার পাবে যে আমার ‘বোধের অধিকার’। আমি অবশ্য বুঝি, যে, আমি এখন কেউ নই যে আমার জন্য কেউ অতোটা করবে?

তুমি লিখেছো, ‘আমি আজো তোমাকে বুঝতে পারিনি সম্পূর্ণ’। সেটি অবশ্যই আমার ব্যর্থতা। আমার ভাষা ও আচরণ দু’টি মাধ্যমই নিদারণভাবে ব্যর্থ হয়েছে এ ব্যাপারে তাহলে।

আমার হৃদয়ের উত্তাপ, আমার তৃষ্ণা দিয়ে যদি এতোদিনে তোমাকে বুঝিয়ে থাকতে না পারি—তাহ’লে কোন্ সাহসে বলবো—‘ভালোবাসি?’

তোমাকে, একমাত্র তোমাকেই আমি ভালোবাসি—তোমাকে ছাড়া আমার চলবে না—তোমাকে ছাড়া আমার জীবন অপূর্ণ। আমি একটা ঝকঝকে শাদা দেয়াল নিয়ে ঘর করতে পারি—কিন্তু বাঁচতে পারি না।

বাঁচার জন্য, প্রচণ্ডভাবে বাঁচার জন্য, সৃষ্টিশীলভাবে বাঁচার জন্য তোমাকে প্রয়োজন। একটি সুন্দর স্বপ্নের জন্য তোমাকে প্রয়োজন। কবিতাই আমার কাছে জীবন, দৈনন্দিন ক্লেশকর আটপৌরে দুঃস্বপ্নে ভরা বাস্তবতাকে মেনে নিই মাত্র— আকর্ষিত হই না, আকাঙ্খা করি না।

আকাঙ্খা আমার অমৃতের জন্য—যে অমৃতের স্বাদ আমি এই প্রথম তোমার কাছেই পেয়েছি। সব জেনে শুনে যে তা দিতে পারে তাকে অসাধারণ বলবো না তো কাকে বলবো বলো।

তুমি অসাধারণ, তুমি অসাধারণ, তুমি অসাধারণ। ভালোবেসে আমি তোমাকে ধুলোয় নামাতে পারি না। তুমি নিজে কবি—এবং নিরপেক্ষ থেকেই বলছি তুমি খুব ভালো লেখো। নিজেকে অযথা ছোট ক’রে দেখো না, দোহাই দিলা।

তোমার কষ্ট কি আমি বুঝি না। নিজে আমি কোনো কাজই করতে পারছি না—পদ্য লেখার ইচ্ছে পর্যন্ত হয় না—সর্বদাই বুকে ব্যথা—কী যে কষ্ট-ভালো লাগে না কিছুই, সর্বদাই তোমাকে কাছে পেতে ইচ্ছে করে—দেখতে ইচ্ছে করে—শুনতে ইচ্ছে করে—স্পর্শ পেতে চাই—গোপনে অন্যদের চোখ এড়িয়ে তোমার ছবিতে যে কতোবার কি বলবো—আমার আর কিছু ভালো লাগে না, তুমি ঠিকই বলেছো, ‘একটি মানুষের জন্য একটি মানুষই যথেষ্ট—পৃথিবীর অন্যসব লোক ঈশ্বরের ব্যর্থ সৃষ্টি।’—ভালোবাসার কাছে সবই তুচ্ছ।

তুমি লিখেছো, ‘তোমার কবিতা প’ড়েই তোমার হৃদয় আত্মস্থ করতে হয়—যা আগেই করেছি—এখনো তাই করতে হবে?’ না, সখি না, প্রশ্নই ওঠে না, এখন থেকে একমাত্র তোমাকে উদ্দেশ্য ক’রেই সব পদ্য রচিত হবে।

ছাপার অক্ষরে অন্যরা দেখবে—তুমি দেখবে খসড়া থেকে শুরু করে ফাইনাল কপি। আমার সাধারণ পাঠক/পাঠিকার উদ্দেশে নয় হৃদয়ের নিভৃতে যার নিবাস তার জন্যে, শুধুই তার জন্যে লিখে যেতে চাই বাকি জীবন।

হৃদয় বেদনার কাছে কবিতা রচনার কষ্ট তুচ্ছ। তা আমিও বুঝি। এবং এজন্যেই লেখা হচ্ছে না। প্রেম যদি সমস্যা হ’য়ে দাঁড়ায় তখন আর তা দিয়ে কবিতা হয় না—কথাটা আমাদের উভয়েরই মনে রাখার দরকার। অমৃত আহরণ করতে গিয়ে আমরা যেন ‘বিষ’ তুলে না আনি।

আমাদের প্রেম ধুলোয় গড়াগড়ি খাক এটা যদি তুমি দেখতে চাও এবং তা তোমার সহ্য হয়, তো তোমার যে কোনো প্রস্তাবে আমি রাজি। ভেবে দেখে বলো। আমার কোনো আপত্তি থাকবে না।

পাগলামি কোরো না দিলা; প্রেমের, ভালোবাসার একটা নিজস্ব গতি আছে তাকে আপন গতিতে চলতে দাও—সে নিজেই নির্দেশ করবে পরিণতি—আমরা যেন মুহূর্তের ভুলে বাকি জীবনের অমৃতকে বিষে পরিণত না করি।

আরো পড়ুন: রফিক আজাদের চিঠি, দিলারা হাফিজকে

Comments to: দিলারা হাফিজকে রফিক আজাদের চিঠি

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    Attach images - Only PNG, JPG, JPEG and GIF are supported.

    Login

    Welcome to Chithipotro

    You are couple of steps away from being one of our family member
    Join Us