আমার প্রিয় মামাবাড়ি,
কেউ বলে নানাবাড়ি, আমরা কেউ আবার বলি মামাবাড়ি। এই জবলপুরের গাঞ্জীপুরার মামাবাড়ি, তোমাকে ঘিরে ছিল কত না স্মৃতি। তুমি আমার শয়নে স্বপনে জাগরনে, সবসময় এক আলাদা অনুভূতি নিয়ে আসো।

তুমি আজো আমাকে ডেকে নিয়ে যাও তো সেই অধুনা অস্তিত্বহীন অবয়বে, এক কমার্শিয়াল সেন্টারে, যেটি তোমাকে ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে তৈরি হয়েছে। খুঁজে বেড়াই তোমার সেই পাথরের উঁচু চবুতরা।

চবুতরা ছাড়িয়ে সেই লম্বা বারান্দা, বারান্দা পেরিয়ে দাদুর ওকালতি চেম্বার,তারপর আরো এগিয়ে সারি সারি ঘর, বারান্দা,উঠোন,– আরো কত কি! ঘরেদের কত যে নাম,– আঁতুড় ঘর, গোয়াল ঘর, ভাঁড়ার ঘর ইত্যাদি।

গোয়াল ঘর পার করে আরো দূরে ছিল গোসল করার জায়গা। বারান্দায় একটি চন্দনা পাখি কি সুন্দর সুর করে ডাকত,–‘ মিঠু-উ-উ-উ—-। আমরা মিঠুকে লাল টুকটুকে লঙ্কা খাওয়াতাম। কি সুন্দর লাল ঠোঁট দুটো দিয়ে বেছে বেছে বিচিগুলো খেয়ে নিত ও। তারপর আবারো ডাকত,– মিইই–ঠুউউউউ—

গরমকালে উঠোনে আর ছাদে হতো রাতের ঘুমের ব্যবস্থা, মজার ব্যাপার– বেশ খোলা আকাশের নিচে বড়মামারা, আমরা ছোটরা সার সার দিয়ে ঘুমোতাম। ভোর হত সুর্যের আলো বেরোনোর সাথে সাথেই। সকাল হলেই সদর দরজায় নবভারত টাইমস্, পেট্রিয়ট পত্রিকা হাজির।

তারপর আমাদের চায়ের কাপ আসতে না আসতেই দূরে আওয়াজ আসত মেছুনী আর দ‌ইওয়ালার।–দহি লো দাহি-ই-ই-।আবার সন্ধ্যের সময় আসত সেই গরম গরম ধোঁয়া ওঠা চুরণ বিক্রিওয়ালা।

বাড়ির পেছনের গয়লা বস্তিতে কে গালিগালাজ করছে, কে মাতলামো করছে,–সব তোমার ছাদে উঠে মজা করে দেখতাম। আর তোমার বিশাল চবুতরাটা আদপে কি ছিল জানি? ‘শ্রীনাথ কি তালাইয়া’ নামের একটি বিরাট দীঘি বা তালাও এর ঘাট ছিল এই উঁচু চবুতরা।

ওই তালাইয়া’র অস্তিত্ব আমার মা, মাসিরাও কোনদিন দেখেন নি। আমরা ওই চবুতরাতেই ঘুঁটি সাজিয়ে পিট্টু খেলতাম, আবার একবার ওখান থেকেই দেওয়ালীর দিন বোতলে করে এমন রকেট বাজি ছেড়েছিলাম যে সেই বাজি সোঁ সোঁ করে উড়ে পাসের চৌবেদের বাড়ির তিনতলার ঘরের জানালা দিয়ে ঢুকে কি অন্বিষ্ট‌ই না করেছিল, আমি তখন পালাবার পথ পা‌ই না।

তোমার দোতলার শেষ মাথায় বড়মাসির ঘর,আমাদের কাছে যা ছিল আশ্চর্য সব উপহারের খনি।বড়মাসি তাঁর আলমারি, দেরাজ থেকে আমাদের ছোটদের জন্য হাত ঢুকিয়ে ‘ট্রেজার হান্ট’ এর মতো বার করে আনত রকমারি উপহার,— রাশিয়া থেকে আনা ব্রোচ, স্যুভেনির,স্কার্ফ আরো কত কিছু।

আর এক পাসে ছিল বড়মামার ঘর,—যেখানে আমাদের জন্য বয়ামে বয়ামে সাজানো থাকত কাজুবাদাম, কিসমিস, আখরোট, আমন্ড, পেস্তা। আবার থাকত বড়মামার রাম্বেল, ডাম্বেল– শরীরচর্চার সামগ্রী।

বড়মামা তো রাজ্যর কম্যুনিস্ট পার্টির নিবেদিত প্রাণ। তাই উপরের বারান্দা জুড়ে ছড়ানো থাকত অসংখ্য প্ল্যাকার্ড, পোস্টার। বড়মামার। মাঝে মাঝে দেখতাম বড়মামার পার্টির ছেলেরা যাদের বড়মামা বলত ‘চেলা’, তারা সব হিন্দি হরফে পোস্টার লিখছে,—‘ ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ ,’ বাইলাডিলা কা নারা হ্যায়’, — ইত্যাদি ইত্যাদি।

তোমার ওই চ‌ওড়া,চ‌ওড়া পাথরের সিঁড়িগুলো আমরা লাফিয়ে লাফিয়ে কি অবলীলায় ভেঙে উপরে উঠতাম তখন। সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা সেই চবুতরাসহ বাড়িটি প্রোমোটারের ছেনি হাতুড়িতে গুঁড়িয়ে যেতে বেশি সময় লাগলো না ।

কলকাতায় বসে খবর পেতাম সেই ধুলিসাৎ হ‌ওয়ার, কিন্তু ধ্বংসের অকুস্থলে একদিন দাঁড়াব, সেই সাহস করে উঠতে পারিনি। কিন্তু যেতে একদিন হল‌ই। বুক বেঁধে ওপাড়ায় দিলাম পাড়ি। দেখলাম এখনো‌ রিক্সাওয়ালা ঠিক ‘শ্রীনাথ কি তালাইয়া’ চেনে।

কতদিন পর রিকশায় চড়ে ওপাড়ায় যখন দূর থেকে ঢুকলাম, তখন দূর থেকে আর্যসমাজ মন্দিরের চুঁড়োটা দেখে মনটা আনন্দে নেচে উঠল। ওই তো সেই মন্দির, যেখানে কত যাগযাজ্ঞ হতো, কত ধর্মান্তরন ঘটতো,– আর আমরা সেই সব অনুষ্ঠান উঁকিঝুঁকি মেরে দেখতাম।

সেই মন্দিরটার গায়েই তো তুমি, আমার আদরের,আমার পরম স্মৃতির মামাবাড়ি গলাগলি করে ছিলে একদিন,– আজ আর তুমি সেখানে নেই। আছে শুধু ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া ফাঁকা জমিতে এক নিষ্প্রাণ ইট কাঠ পাথরের অবয়ব। সেই দাদু, দিদা,বড়মামা, বড়মাসী, মামীমা আজ হারিয়েছেন কালের গর্ভে।

আমরা ভাই বোনরা দেশের এক এক প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লাম। আমি শুধু সেদিন চেয়েছিলাম তোমার সামনে নতজানু হয়ে একটু অতীতের সেই সোঁদা সোঁদা স্মৃতির আঘ্রাণ প্রাণভরে শুষে নিতে।

কিন্তু তা পারলাম কই, ওই নিষ্প্রাণ বহুতলের সামনে আমি কোথায় যেন হারিয়ে গেলাম, বুকের ভেতর থেকে একটি দলা পাকানো যন্ত্রণা যেন বেরিয়ে আসতে চাইছে, কিন্তু আসতে পারছে না। কি কষ্ট! কি কষ্ট!নাহঃ, এই স্মৃতির ধ্বংস রূপ আমি চাই না প্রত্যক্ষ করতে।

তোমাকে কেন খুঁজে পেলাম না, আমার মামাবাড়ি— যাকে অনেকে নানাবাড়ি বলে ডাকে। তুমি আমাকে আজো যে ঘুমের মধ্যে ভাসিয়ে নিয়ে যাও কোন সুদূরে, কোনো এক অচিনপুরে—

ইতি—
তোমার সুদীপ।

লেখা: সুদীপ দাশ

Comments to: স্মৃতি রোমন্থন

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    Attach images - Only PNG, JPG, JPEG and GIF are supported.

    Login

    Welcome to Chithipotro

    You are couple of steps away from being one of our family member
    Join Us