শিরোনামটিই যেন কেমন, না? মন খারাপ করা, বিষণ্ন একটা অনুভূতিতে মন ছেয়ে দেওয়া। অথচ প্রেম মানবজীবনে এক শাশ্বত অধ্যায়ের নাম। একটি অসাধারণ অনুভূতির নাম। প্রেমহীন জীবন কোনো জীবনই না। অনেকে বলে বা বলতে চায়, তার জীবনে প্রেম আসেনি বা সে প্রেমে পড়েনি। এটি একটি ভুল কথা। প্রেম এসেছিল।
হয়তো সে টের পায়নি। ‘প্রেম একবারই এসেছিল নীরবে’ গানটির মতো। সঠিক সময়ে সে টের পায়নি। আবার কারও জন্য প্রেম অনুভব করলেও সেটা প্রকাশ করার মানসিক শক্তি অর্জন করে উঠতে পারেনি। যে বা যারা পারেনি, তারা দুর্ভাগা! নিরন্তর বিরহে পোড়াই তাদের ভবিতব্য।
একসময় প্রেম প্রকাশের একমাত্র মাধ্যম ছিল প্রেমাস্পদকে চিঠি লেখা। রঙিন খামে, নানা ধরনের নকশা করা প্যাডে চিঠি লিখত প্রেমিক প্রেমিকাকে বা প্রেমিকা তার প্রেমিককে। অনেকে স্কুল-কলেজের ক্লাসের খাতার পৃষ্ঠা ছিঁড়ে তাতে চিঠি লিখত। রুল টানা বা সাদা পৃষ্ঠায় লেখা হতো চিঠি। কত ছন্দ, কত কবিতা, কত গানের কলি প্রাণ পেত সেসব চিঠিতে। কি না থাকত চিঠির বুকপকেটে? হৃদয়ের যত আকুতি ভরে থাকত সেসব চিঠি। কত কান্না, কত যন্ত্রণা, কত হাহাকারই না শব্দ হয়ে ঝরে পড়ত চিঠির পাতায়। কত রাত বিনিদ্র রজনী কেটে যেত একটি চিঠির ভাষা মনে মনে গুছিয়ে নিতে।
চাইলেই সে চিঠি স্বপ্নের মানুষের কাছে পৌঁছানো যেত না। দরকার হতো কাছের মানুষের সহযোগিতার। বিশ্বস্ত হতেও হতো সেই সব মানুষের। চিঠি আদান-প্রদান করতে করতে চিঠির বাহকের প্রেমে পড়ে যাওয়ার ঘটনা জগৎজুড়ে কম নেই। তাই সতর্কতা দরকার হতো এখানেও।
ডাকে চিঠি পাঠিয়েও স্বস্তি ছিল না। ঠিকমতো প্রাপকের হাতে পৌঁছাল কি না এই মানসিক চাপ সহ্য করা সহজ ছিল না। তার ওপর ধরা পড়ার ভয়। যদি চিঠি মুরব্বি গোছের কারও হাতে পড়ত, তাহলে তো শেষ। রীতিমতো দরবার বসত। চিঠির প্রাপকের তখন একঘরে অবস্থায় পড়া ছাড়া গতি ছিল না। তবু কি চিঠি লেখা থেমে থাকত? না বুকের নিচে বালিশ চেপে উপুড় হয়ে মনের মানুষটিকে চিঠি লেখার তাড়া থেকে কোনো বাধাই আটকে রাখতে পারত না।
ইতিহাসখ্যাত বহু মানুষ রয়েছে, যাদের চিঠিও লোকের আগ্রহ তৈরি করতে পেরেছে।
চিঠিতে কত নামেই না সম্বোধন করা হতো প্রেমের মানুষটিকে। প্রিয়তমা, মায়াবিনী, স্বপ্নের রানি, পাখি থেকে আরও কত-কী! সেই চিঠি পাঠিয়ে তারপর তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা। চাইলেই তো আর চিঠির জবাব পাওয়া যেত না। অপেক্ষা করতে হতো ক্ষণ, দিন আর মাসের।
এখন আর কেউ কাউকে চিঠি লিখে না। গ্রামে-গঞ্জে এমনকি শহরাঞ্চলের ডাকবাক্সগুলো মরিচা পড়ে মলিন। অথচ এগুলো কত সম্পর্ক গড়ে ওঠা আর হৃদয় ভাঙার ইতিহাস বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত ঠায়।
তাহলে কি মানুষের মনে এখন আর প্রেম নেই? প্রেম আছে। থাকবেও। কিন্তু প্রযুক্তির কল্যাণে প্রকাশের ধরন পাল্টেছে। পাল্টেছে মাধ্যমও। এখন যোগাযোগ হয় ভার্চ্যুয়ালি। ইচ্ছা হলেই কথা বলা যায়, দূরত্ব যতই হোক একে অন্যকে দেখতে পারে। মেসেঞ্জারে, ইমো, ভাইবার, হোয়াটসঅ্যাপের মতো ছোট ছোট অ্যাপস পুরো বিশ্বকে এখন হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে। ছোট ছোট বাক্যে একে অন্যকে ভাব প্রকাশ করতে পারে সহজেই। এখন আর কাগজ-কলম নিয়ে দীর্ঘ চিঠি লেখার দিন নেই। এ ছাড়া বেড়েছে মানুষের ব্যস্ততাও। মানুষ পথে যেতে যেতে মুহূর্তে বার্তা পাঠিয়ে দেয় মনের মানুষের কাছে।
তবে এটা ঠিক প্রেমপত্র লেখার যে আবেদন, তা কখনোই অন্য কোনো কিছুর সঙ্গে তুলনায় আনা যায় না। যা কিছু সহজ বা বিনা বাক্য হাতের মুঠোয় চলে আসে তা দিন দিন গুরুত্ব হারানোটা স্বাভাবিকই। যে কারণে প্রেম আছে, তবে ঠিক যেন সেই সুর আর ছন্দে নেই। তবে এখনো চেষ্টা করা যেতে পারে প্রেমপত্র বাঁচিয়ে রাখার।
সেটা হতে পারে নতুন প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করে। যারা একটু ভাবুক, লিখতে পছন্দ করে, এমন মানুষের কাল্পনিক প্রেমপত্র লেখার আমন্ত্রণ জানানো যেতে পারে। যেসব বিখ্যাতজনের প্রেমপত্র নিয়ে লেখালেখি, আলোচনা হয়েছে, সেগুলো নিয়ে কথা বললেও অনেকে আগ্রহী হতে পারে প্রেমপত্র লিখতে।
প্রেম শাশ্বত, প্রেম অসাধারণ এক অনুভূতির নাম। একমাত্র প্রেমই পারে জগতের সব অন্ধকার সরিয়ে আলোর পথের যাত্রা সুগম করতে। একের প্রতি অন্যের সেই প্রেমের প্রকাশ ঘটুক অসাধারণ সব চিঠি লেখার মাধ্যমে। প্রেম হারায়নি, হারায় না। তবে কেন হারাবে প্রেমের চিঠি?
লেখা : সাবিরা ইসলাম
সূত্র: রোদসী
No Comments
Leave a comment Cancel