কলকাতা
4th June 72

শ্রদ্ধেয় রাহমান সাহেব,

আপনার ৪/৫ তারিখের পত্রটি আমি খুবই নিষ্ঠার সহিত পাঠ করিয়া থাকি; ঠাকুর কৃপা, বৈ-অন্য ধারণা করা অকৃতজ্ঞের হইবে, যে আমার প্রতি আপনি কিছুটা মন নিয়া থাকেন। ইহা আপনার মহানুভবতা- ইহা আমাতে গভীর শ্রদ্ধা আনিয়াছে; শ্রদ্ধা শব্দটি আমার কিছুতেই মৌখিক নহে, যে এবং ইহার পর হইতেই আমি সকল কিছু বাস্তব। অবধারণ করিয়া থাকি।

আপনার চিঠির উত্তর দিতে এত বাঙালীসুলভ দেরীতে হইল বলিয়া আমি মরমে অতিমাত্রায় কুণ্ঠিত রহিয়াছি, এমন native ব্যাপার আমার দ্বারা, যত দূর মনে পড়ে, কখনও ইতিপূর্বে ঘটে নাই; যে এমন অভিমান আমাতে আছে, যে আমি চিঠির উত্তরে খুবই তৎপর। এখন আমার দোষ স্থানে চেষ্টা করাও অশালীন হয়।

আপনার স্ত্রী খানিকটা সামলাইয়া উঠিয়াছেন খবরে আমি খুবই নিশ্চিন্ত বোধ করিলাম; এ কারণ যে, যে দিবস আপনার সহিত আলাপ করার সৌভাগ্য হয়, ঠিক ঐ সময়েতে ঐ টেলিগ্রাম আসিল; যে সকলেই আমরা খুবই অসহায় বোধ করিলাম, সকলেই কি কর্ত্তব্য যে তাহা, নির্ণয়ে বেসামাল হইয়াছিলাম, অপ্রস্তুত ছিলাম; যে এখন ঐ সংবাদে আমি স্বস্তিতে আছি।

আপনার কবিতার গ্রন্থ যাহা আমারে আপনি দয়াপরবশ হইয়া দিয়াছেন তাহা আমি পাঠ করি- যে এখানে করি ক্রিয়াপদেতে বর্তমান নির্দেশিত হইল, বাঙলা ভাষা এখনও চাষাভুষোরা বেশী বলে, ফলে, অতীত বর্তমান ভেদ সঠিক আমার ধারণা নাই- আমি নিজে কবিতা খুব ভালবাসি; কেননা ইহা আমাকে উদঘাটন করে, শব্দর সংমিশ্রণকে লইয়া নির্মাণকারী এক রহস্যময় পরিবেশ সৃষ্টি করিল, যে এবং তখনই আমি ঘটিয়া উঠিতে থাকি। আমাদের মধ্যে আপনার কবিতা তেমনি ঘটনার সৃষ্টি করিয়া চলিতে থাকে;

শিশুরা উজ্জ্বল খেলে কিংবা [২০ পৃ.]।

আমরা স্বাভাবিকভাবে, যেমন কোন ছন্দ পাঠ করি, আমরা উৎকর্ণ যে কখন চমকপ্রদ একটা metaphor সাক্ষাৎ হয়, যাহা খুব চৌকস নাটকীয়; ইহাকে অবহেলা করার নাই;

এখানেতে, ঐতে ঐ লাইনে সমস্ত মানসিকতা সজীব মানুষের- ইস্‌ মনুষ্যত্ব মানবতা শব্দগুলি, কি আনদাজ কাগজী policy, যতক্ষণ না বন্দুকের আওয়াজ হয় ততক্ষণ শ্রুত হয় না- এখানে আপনার দৃষ্টিভঙ্গী অন্য, ইহা ধ্রুব। আপনি স্বাধীনতাকামী, এই স্বাধীনতা ‘স্বাধীনতা তুমি বোনের হাতের নম্র পাতায় মেহেদির রঙ’- আমি নিজে জানিবেন আমি ambitious প্রতিক্রিয়াশীল, প্রগতিতে বিশ্বাসী নাই, কেননা আমি নহি।

তাই মনে হয় স্বাধীনতা এখানে আধ্যাত্মিক যাহারে aesthetics নির্ম্মাণ বলা হইয়া থাকে। ‘শিশুরা উজ্জ্বল খেলে’ এখানে ‘খেলে’ যদি খেলাও হয় তাহাতে নিষেধ নাই, উহাতে সমান সৌন্দর্য্য রহিবে, ধর্মও রহিল।

সাধারণত বঙ্গীয় ধারায় আধ্যাত্মিকতাই সব, কিন্তু তাহা mystification নহে যাহা আমার আপনার পক্ষে- গোপনে বলি; রবিঠাকুরের আতিশয্যে যাহা হরদম, ছত্রে ভাবে- অতীব সোজা কারণ ভাঙ্গা সুফীবাদ-এর সহিত সহজ তত্ত্ব; সান্ধ্য ভাষার অনুকরণে, দেশ আউল বাউলে শ্রীহীন হইয়াছে; অনেকাংশে কোন পুরাতন গীত বা ছন্দর শব্দ ফের হইয়া থাকে।

এখানে যে এই কথা বলা যায় নিছক fun করার মত সাধারণ অভ্যাসই ক্ষেত্র সকলেতে কাজ করে, ইহা স্পষ্ট হয়। যে উহার কোনই কম্পন নাই। ইহাতে monotony মনোরমত্ব যে নাই তাহা জানা যায়। আপনার স্থিরতা সমতা গুণ আমাকে কিভাবে মতিত্ব দিয়াছে এত সকল নিশ্চয়ই ঠাকুর জানেন সেই সূত্রেই বৈ অন্য না। তিনবার হলপ করিতে পারি।

যুদ্ধের বিরুদ্ধতা করার ক্ষমতা আমাতে নাই; বরং প্রায়ই তাহার সুযশ কহিয়া থাকি কারণ আপনিও যেমন একদা ইহা অনুভব ‘বন্দী শিবির থেকে’ করিয়াছিলেন, কারণ যে ভারতবর্ষ স্বাধীন দেশ, কিন্তু পরাধীনরা এখানে বাস কপাল দোষে করে।

যুদ্ধ যদি কুৎসিত তবে তাহা সব ক্ষেত্রেই উহাই, আমি নিজে মোটেই coward নই (বহু হাজতবাস করিয়াছি) যে এবং মাথা আন্দোলনে প্রতিবাদ করি, মারধর করার বৃত্তি কিছু সাহসের না। যে এবং আমি যুদ্ধকে পছন্দ করি না, অথচ ছোট কাহার জন্য : toy gun পছন্দ করি।

এমন পারিপার্শ্বিকতায় রহিয়াছি যেখানে আমার বংশমর্যাদা হতশ্রী হইল! আপনার যুদ্ধকালীন রল্প্রব্দগত পর্য্যায় আপনাকেই আবহমানকালই দেখাইল। তাহার ব্যতিক্রম নাই যে তাহা অনেক শ্বাসকষ্ট যাহা আমি শুনিতে পাই, ইহা বড় আশ্চর্যের না! তবু শুনতে পাই।

কলিকাতা এখন বেশ মজায় রহিয়াছে, কাগজই এখানকার তাকৎ, ল্যাংড়া আম থাকা মানে বাজারে-আসা অবধি রবিঠাকুরের জন্মদিন হইবে, উপরন্তু খানাকুলের রামমোহন বাবুর আবার জন্ম বছর, বক্তৃতার লোক অনেক। ছোটবেলাতে মামাবাড়ী যাইতাম- দুর্গাপূজা হয়।

দুর্গাপূজার প্রথম ঘণ্টা উহার ঢাক, ঢাকীরা আসিত, ঢাকীরা সাধারণ গরীব বেচারা হয়। তাহাদের উপর তম্বি করা আমার পক্ষে সোজা, আমরা বলিলে একটু কাঠি চালাইত। তেমনই কত বেটারা কলিকাতায় আছে, যেমন সৌমেন ঠাকুর, যেমন অন্নদাশঙ্কর ইত্যাদি বলিলেই বন্ধুগণ বলিয়া আরম্ভ করিবে। যেমন কাজীর সম্পর্কে, কোনদিন কবিতাও বা গান ত দূরের কথা- পড়ে নাই।

আজ ফাটাইয়া রেডিও মাৎ করিতেছে, ইহারা যাহারা অদ্য লাফ প্রদান করিতেছে তাছাড়া কাজী যে বাঙলার কতখানি তাহা জানে না, সজনী দাস আক্রোশে লিখিয়াছিল ‘পাড়ার যত ঝাকড়া চুলো গাইছে গজল নজরুলিয়া’। কাজীর গান গজল যেমন সত্য, তেমনি সুরের রকমফের যেমন ‘ঘুম ঘোরে’ এমন চালের চমকপ্রদ লয়ের তারতম্য কে শুনিয়াছে।

এইখানে আমি রাজনীতিকে বাহবা দিয়া থাকি- না হইলে কবে কাজী উবিয়া যাইত। চিতাতে আমাদের স্মৃতিও একদিন ধোঁয়াকুণ্ডলী পাকাইয়া ঊর্ধ্বে উঠিত। অশিক্ষিত দেশে এমনই হায় ঘটিয়া থাকে। যে মানুষ দুর্গম গিরি কান্তার মরুতে দেশকে উদ্বুদ্ধ করেন তাহাকে policy তে মনে রাখিব।

আমরা ছেলেবেলাতে, নিত্য পূজায় সাঁওতাল পরগনাতে আমাদের বাড়িতে যাইতাম, শিকার পিকনিক গান থিয়েটার এই ছিলো বিনোদন। আমরা কখনো জোর গলাতে কাজীদার ‘দুর্গমগিরি’ গাইতে পারিতাম না, পুলিশের ভয়। রিখিয়াতে অনেক রকম লোক সেখানেও সুবিধা ছিল না, আমার কাকারা এক পার্টি দিলেন; সানোয়ার জঙ্গলে, এখানে শাল এবং অর্জুন মহুয়ার বন।

যে ঐ বনেতে নম্বরী (যাহারা গাছেতে নম্বর দেয়) লোক কচিৎ আছিল, আমরা এই বনে গিয়া প্রাণ ছাড়িয়া দুর্গমগিরি গাহিলাম। গান এমত হয় যে পাহাড় বন গম্‌-ইত হইয়া উঠিল, আমাদের প্রত্যেকের ভারী সুন্দর দেখাইতেছিল, আমরা সৌন্দর্য্য! এমত সময় আমার এক পিসি, যাহার হাতেও বন্দুক ছিলো, কহিল, দেখ, দেখ, একজন আমাদের নজর করিতেছে, অনেকক্ষণ ধরিয়া, আমার চোখে পড়িতেই ঐ ব্যক্তি আড়ালে যায়।

যে ইহাতে ঐ গীত অদ্ভুতভাবে থামিয়া থাকে, গীত পদ্ধতিতে নানান ছাড় কায়দা আছে, দেশীয় বিদেশীয়তে, থমকে এক আধশব্দ আবার পরম্পরা আবার একটি স্পষ্ট-চমৎকার। সমবেত সকলের চোখে পিসির অঙ্গুলি নির্দেশিত স্থানে যায়। কেহ ভুলক্রমে বন্দুক উঠাইয়াছে, আমার বাবার colt হইতে (রিভলবার) আওয়াজ শোনা গেল।

আমরা ভীত সকলে anarchist যে তাহা ঐ গীতে কবুল হয়। আমরা শ্নথ ক্লীব হইলাম। ঐ ব্যক্তি  spy হইতে পারে তখন spy ভীতি যম হইতেও মারাত্মক! তখনও ঐ গীত প্রভাবে আমাদের মুখমণ্ডল আরক্তিম ছিল, গীতের রেশ ত্বকে আছে! সেদিন প্রবল বৃষ্টি হয়, সেই লোকটি অত বৃষ্টিতেও অনেকবার বেশ নিকট হইতে আমাদের লক্ষ্য করিতে আছে, সন্ধ্যায় হাতে অনেক নানাবিধ পাখী শিকার, সেগুলি ভিজিয়া কদাকার।

আমরা গরু গাড়ীতে উঠিলাম, অন্ধকার সাঁওতাল পরগনার রাস্তা খানিক চড়াই উৎরাই-হঠাৎ একটা লোক! সব গাড়ী থামিল; সে কহিল, ‘আমি নম্বরী আমায় ঐ গানটা লিখিয়া দিবেন দয়া করিয়া, আমি একা থাকি, গান বড় সুন্দর, গাহিব’। আমরা তাহারে হিংসা করিয়াছিলাম। সে ঐ বনে নির্ভাবনায় কাজীদার গীত গাহিবে।

পত্রের উত্তর সময় পাইলে দিবেন। আপনার স্ত্রী এবং পুত্রকন্যাদের মঙ্গল হউক।

ঠাকুর আপনাকে আনন্দে রাখুন।

ইতি অনুগত
কমলকুমার মজুমদার।

Comments to: শামসুর রাহমানকে লেখা কমলকুমার মজুমদারের চিঠি

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    Attach images - Only PNG, JPG, JPEG and GIF are supported.

    Login

    Welcome to Chithipotro

    You are couple of steps away from being one of our family member
    Join Us