৩.১.৮২/ রাত ৩.১৫
দিলা, আমার দিলা,
তোমার মুখোমুখি, পাশাপাশি অনেকদিনই তো বসেছি, অনেক প্রয়োজনের, অপ্রয়োজনের কথা হয়েছে, হয়েছে আধুনিক কবিতা নিয়ে দীর্ঘ নিরবচ্ছিন্ন আলোচনা।
মাঝেমধ্যে তোমার দু-একটি কথায় কষ্ট পেয়েছি; হয়তো আমার অগোচরে আমিও তোমাকে কষ্ট দিয়েছি। কিন্তু পরস্পরকে আমরা কতোটা চিনতে পেরেছি, বা প্রকাশ করতে পেরেছি? আমি কিন্তু সত্যিই বাকপটু নই একটুও।
নীরব ভাষায় যতোটা নিজেকে প্রকাশ করতে পারি, তারো চেয়ে অনেক কম পারি ভাষা-ব্যবহারে। গভীর গোপন কোনো কথা কি ভাষায় ব্যক্ত করা সম্ভব? আমার ধারণায় নেই, তোমার আছে?
তোমাকে আমার খুব ভয়। ভয় এই কারণে যে, পাছে তুমি আমায় ভুল বুঝে না বসো; তা-হলে আমার বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। ভয় এই কারণে যে, আমার কোনো কথায়, কোনো ব্যবহারে তুমি আঘাত পাও, তা আমি চাই না।
তোমাকে ভয় এই কারণেও যে, তোমাকে আজো আমি পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারলাম না;—অথচ তুমি মোটেই রহস্যময় নও, নও মোটে অস্পষ্ট চরিত্রের মানুষ—তুমি মোটামুটি খোলামেলা এবং দিবালোকের মতো পরিষ্কার। তবুও ভয়…
তোমার সর্বাঙ্গীণ মঙ্গলই আমার কাম্য : আমি চাই কবি হিসেবে তুমি শক্তভূমিতে দৃঢ় পায়ে অন্য সবার মাথার উপর, অনেক উপরে উঁচু হয়ে দাঁড়াও এবং সর্বোপরি ভালো থাকো। তোমাকে আমি সুখী দেখতে চাই, দেহ-মনে সুস্থ, প্রাণোচ্ছল, হাশিখুশি।
তুমি কতো সহজে সামান্য ব্যাপার নিয়ে কবিতা লিখতে পারো, আমি পারি না। তাৎক্ষণিক ব্যাপার আমার পক্ষে লিখে-ওঠা খুব কষ্টকর। তুমি নিজেই তো দেখেছো, তোমার খাতায় লেখা কবিতাটি।
তুমিই তো মন্তব্য করেছিলে ‘উপদেশ’। কিন্তু আমি মোটেই ওই অর্থে লিখিনি ওটা সেদিন। ‘জেগে-ওঠা’ বলতে আমি অন্যকিছু বোঝাতে চেয়েছিলাম, বোঝাতে পারিনি, আমারই ব্যর্থতা সেটা।
ওটা তো কবিতা ছিলো না, ঐ লেখাকে চিঠিই বলতে পারো। কিন্তু ঐ যে আমি বলেছি ভাষা-ব্যবহারে কোথায় যেন একটা গ্যাপ রয়ে যায়। আমি কথা কম বলতে চাই ঐজন্যেই, চোখের ভাষায় বলতে চাই মনের কথা।
একটি-দুটি ক্ষেত্র ছাড়া আমি প্রধানতই রূঢ়—আমাকে অন্য অনেকে নিষ্ঠুর গুণ্ডাপ্রকৃতির লোক বলেই জানে, বুঝলে কোমল পাথর?
তোমার সঙ্গ আমাকে শান্তি দ্যায়। গ্রীষ্মকালে, দুপুরে শীতল পানীয়ের চেয়েও শান্তি প্রদায়িনী তোমার সঙ্গ।
বলতে দ্বিধা নেই তোমাকে খুব ক’রে কাছে পেতে চাই, আরো দীর্ঘ দীর্ঘক্ষণ; অথচ তোমাকে আঘাত ক’রে নয়, তোমার দিক থেকে কোনো দ্বিধা বা অসম্মতি বা বিন্দুমাত্র তোমার মর্যাদা ও অভিমানকে আহত ক’রে নয়।
আমি জানি, এ আমার অসঙ্গত, অসমীচীন চাওয়া। তুমি কি আহত হলে?
যাকগে। তুমি কবিতা লেখার জন্যে চাপ দিচ্ছিলে। কবিতা এবং জীবনে আমি কোনো পার্থক্য করি না। আমি যা ফিল করি জীবন দিয়ে তাই লিখি, এজন্যেই না-পাওয়ার; বিষাদের, বেদনার কবিতায় আমার বই ভরপুর।
ব্যর্থতা ছাড়া আমার কোনো মৌলিক আন্তরিক অভিজ্ঞতা নেই যে, দিলা! ব্যর্থতার কথা লিখতে বড় কষ্ট হয়, হৃদয়তন্ত্রীতে ক্যানেস্তারার মতো ঝনঝন শব্দ ওঠে—ও আমি আর লিখতে চাই না; না-পাওয়ার কথায় আমার কবিতা বড় বেশি ভারী হয়ে আছে, আহত হয়েছি বারবার।
ঐ ধরনের কবিতার সংখ্যা আর বাড়াতে চাই না। তার চেয়ে বিদ্রোহের বিপ্লবের কবিতা বরং লিখবো। সেক্ষেত্রেও কোনো নারীর আন্তরিক প্রেরণা আমার প্রয়োজন, কোনো বিপ্লবী পার্টির নয়।
তোমাকে আমি বিপদে ফেলতে চাই না, তোমার সম্মুখের সুন্দর জীবনকে আমি নষ্ট করতে চাই না। আমি চাই তুমি আরো সুন্দর হয়ে ফুটে ওঠো, আমি প্রাণভরে দেখি। তোমাকে খুব বড়, প্রতিষ্ঠিত দেখতে চাই।
তোমার মধ্যে যে বিপুল বিশাল সম্ভাবনা আছে, তাকে সম্ভব করে তোলো। উপদেশ নয়, আন্তরিক আকাঙ্খার কথাই বললাম।
আমার কিছু ভালো লাগে না। সারাজীবন এলোমেলো চললাম। ভেবেছিলাম সংসারে আবদ্ধ থেকে, বন্ধু সঙ্গ পেয়ে মোটামুটি কাটিয়ে দেবো কায়ক্লেশে জীবনটা।
কিন্ত হলো কই! পরিবর্তে দিন-দিন নিঃসঙ্গ হয়ে যাচ্ছি। বাধ্য হয়েই আমি পানীয়ের শরণাপন্ন হয়েছি, বিলাস বা ফ্যাশনের কবলে প’ড়ে নয়।
পানীয় আমাকে ভুলে থাকতে সাহায্য করে, অনেক অপমান, দুঃসহ যন্ত্রণা, কষ্টকর জীবনযাপনের গ্লানির হাত থেকে রক্ষা করে। আমাকে উদ্ধার করার জন্যে পানীয় ছাড়া অন্য কোনো সমুজ্জ্বল হাত এগিয়ে আসেনি তো।
আমার কিছু ভাল্লাগে না।
অনেক আবোল তাবোল লিখলাম। নিজ গুণে ক্ষমা ক’রে দিও। তোমার একটা স্পষ্ট, অ-দ্ব্যর্থক দীর্ঘ চিঠির প্রত্যাশায়।
তোমার—
জীবন
[ওটাই আমার ডাক নাম]
No Comments
Leave a comment Cancel