অতন্দ্রিলা, মা গো আমার,
আজকে যখন এই চিঠিখানা লিখতে বসেছি, তখন বাইরে ঝাঁ ঝাঁ করছে রোদ্দুর। আগুনের ঝলক যেন তেড়ে আসছে আকাশের গা বেয়ে। বারান্দার দরজা খুলে একটু কেবল উঁকি দিতে গিয়েছিলাম, চমকে আবার ফিরে এসেছি সপাটে দরজা লাগিয়ে। এই রোদে রাস্তাঘাটে লোকজনও কমে গেছে। তুমি ঘুমিয়েছ কিছুক্ষণ আগে। এখন অন্তত দুটো ঘণ্টা তুমি শান্ত হয়ে ঘুমোবে। খুকু ঘুমোলো পাড়া জুড়ালো…।

খুকুমণি আমার,
আজ তোমাকে লিখতে বসেছি। এর আগেও আমি লিখেছি তোমাকে। যখন তুমি ছিলে আমার গর্ভে, অনাগত ভবিষ্যৎ হয়ে। তখন তোমাকে লেখা সেই সব টুকরো কথামালা আমি জমিয়ে রেখেছি। একদিন তুমি পড়বে এলোমেলো অথবা গোছানো, সে যাইহোক, সেই কথার রাশি। এখন তোমার বয়স প্রায় সাড়ে তিন বছর। আজ আমার জীবন এবং চারপাশ অনেকটাই বেশ বদলে গেছে। আসলে এই পৃথিবীটা তো প্রতিদিনই বদলায়। আমাদের চারদিকে থাকা প্রাণ প্রকৃতি, আমাদের দেশ, সমাজ, আমাদের আপন পর মানুষগুলো সব- সব বদলে যায়। সেদিনের সেই ছোট্ট তুমি, সেও আজ কুট কুট করে কথা বলা দুরন্ত মেয়ে হয়ে উঠেছ। স্কুলে যাচ্ছো। নাচছ, গাইছ, ছবি আঁকছ। আমি অবাক হয়ে তোমাকে দেখি। যত দেখি, আমার ভেতরে এক প্রবল আনন্দসংগীত তৈরি হয়, আর তার সুর আমার সর্বাঙ্গ বেয়ে ওঠে আর নামে।

মামণি আমার,
আজকে এই খররোদের দিনে, তপ্ত দুপুরে তোমাকে কত কথাই বলতে ইচ্ছে করছে। জানি না, এই লিখে রাখা কতটা দরকারি। কেননা আমি তো তোমাকে ঘিরেই আছি। সারাক্ষণ। জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে হয়তো আমি তোমাকে নানা পরিস্থিতিতে নানা কথা বলতে পারব। কিন্তু তবু মনে হয়, অনেক সময় এর বাইরেই আমাদেও ভেতরে এমন কিছু কথা জমে থাকে, যা সব সময় সময়মতো গুছিয়ে বলে ফেলা সম্ভব হয় না। হয়তো এই চিঠিতেই আমি বর্তমান ও অনাগত সময়ের অনেক না বলা কথা লিখে রাখতে চাই। জানি না কতটা পারব। তবু, যদি কোনো দিন আমি তোমার পাশে না থাকি, যদি আমার আয়ু ফুরায়, তবু জেনো, আমার ভালোবাসা তোমাকে ঘিরে থাকবে সর্বক্ষণ। আর এই চিঠির ভাঁজে ভাঁজে হয়তো আমি একটু হলেও ধরে রাখতে পারব তোমার জন্য আমার বুকের ভেতরে জমে ওঠা শব্দগুলোকে। হয়তো এই কথাগুলো আমি তোমাকে নিমিত্ত করে বলতে চাই সবাইকে, হয়তো তোমার মতো আরও ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের, কিংবা হয়তো আমার মতো বয়স্কদেরও। হয়তো বলতে চাই আমার সহযাত্রী মানুষগুলোকে, কিংবা আমার বন্ধু বা শত্রুকেও। মানুষ বড় আজব মাগো, তার বুকভরা শুধু কথা জমে থাকে। আর সেইসব কথা নিয়েই তাকে ফিরে যেতে হয় মহাশূন্যে।

তোমাকে খুব কঠিন কথা বলে ফেললাম। আমি জানি, একদিন তুমি ঠিক এর মানে বুঝতে পারবে।
অতন্দ্রিলা,

বাইরের রৌদ্র দেখে মনে হলো, বারান্দায় ছোট্ট একটা পাত্রে জল রেখে দেওয়া দরকার। এই সময় তৃষ্ণার্ত হয়ে বহু পাখি নাকি প্রাণ হারায়। ছোট টিনের বাটিতে পানি নিয়ে রেখে এলাম। এই ছোট্ট কাজটা মনের ভেতরে কী এক শান্তি যে দিল! ঠিক যে রকম বাজার করে ফেরার পথে রিকশাওয়ালাকে দশটা টাকা বাড়িয়ে দিলাম ভাড়ার সঙ্গে। লোকটার চোখেমুখে ঘাম, শার্টটা ভিজে সপসপে হয়ে আছে। আমাকে নামিয়ে দিয়েই সে আবারও ছুটল আরেকজন প্যাসেঞ্জার নিয়ে। এক মুহূর্ত সময় নেই তার সময় নষ্ট করার। দেখো, আমি ওকে যা দিলাম, আমার ভ্যানিটি ব্যাগে রাখা টাকার তুলনায় তা নিতান্তই যৎসামান্য। সে যা আয় করেছে, তার সঙ্গে তাকে এই বাড়তি দশটি টাকা দিতে আমার খুব কষ্ট হবে না। লোকটাও বিরাট কিছু পেয়ে গেল না বটে। কিন্তু মাগো, এই প্রচ- গরমে, লোকটির ঘামে ভেজা মুখ আর শারীরিক পরিশ্রমের কষ্ট যে আমাকে তার প্রতি সহানুভূতিশীল করে তুলেছে, আমি যে তার প্রতি আমার ভালোবাসা আর সম্মান জানালাম, এটা ওই বাড়তি টাকাটুকু দিয়ে আমি কিছুটা বোঝাতে চেয়েছি। কতটুকু হলো, তা জানি না। কিন্তু আমার চেষ্টাটা রয়ে গেল। লোকটাও হয়তো বুঝল। এই পৃথিবীতে সবচেয়ে দুর্লভ হলো ভালোবাসার প্রকাশ। তারও চেয়ে দুর্লভ তাকে বুঝতে পেরে সাদরে গ্রহণ করার ক্ষমতা।
আজকে দুপুরে আমি যখন লিখতে বসেছি, ডেক্সটপে খুলে রাখা বেশ কয়েকটি নিউজ পোর্টাল। সিরিয়ায় আত্মঘাতী বোমা হামলায় নিহত দুইশ মানুষের ভেতরে শিশু-কিশোর ছিল আটষট্টি জন। আহত-নিহত শিশুর রক্তে ভেসে গেছে ম্যানচেস্টার। সেইসব রক্তমাখা খবর পড়তে পড়তে আমার হাত-পা হিম হয়ে আসে এই প্রচ- গ্রীষ্মেও। জানি না এ কোন পৃথিবীতে আমি নিয়ে এলাম তোমাকে। আর কোথায়ই বা রেখে যাব? কার কাছে রেখে যাব? আমার মতো করে কে তোমাকে রাখবে এমন বুকে করে?

মা আমার,
পৃথিবীতে এমন বিরামহীন নিষ্ঠুরতা দেখে দেখে আমি ক্লান্ত হই। যেহেতু আমি মা, তাই আতঙ্কিত, ভয়ার্ত হই আরও বেশি। তোমাকে স্কুলে পাঠিয়ে, পার্কে খেলতে দিয়ে, বন্ধুদের বাসায় আনন্দ করার অনুমতি দিয়ে আমি ঠিক না ভুল করব, কোনটা হবে আমার সঠিক সিদ্ধান্ত, তা কি আমিই বলতে পারি? তা কি আসলে কেউ বলতে পারে? এ রকম এক দুঃসময়ের ভেতর দিয়ে বয়ে চলেছে এই পৃথিবী আজ, আমি জানি না, ঠিক কোন কাজটি করলে আমি তোমাকে এই সমস্ত নরকতুল্য পরিস্থিতি থেকে দূরে রাখতে পারব।
প্রতিদিন পত্রিকার পাতাজুড়ে কন্যাশিশুর প্রতি জঘন্য বর্বর অত্যাচারের যে খবর আমি পাঠ করি আর কষ্টে বেদনায় যন্ত্রণায় ক্ষতবিক্ষত হই, আমাদের রাষ্ট্রনায়কদের কর্ণকুহরে মায়ের সেই কান্না পৌঁছায় না। তারা বড় নির্বিকার, নিস্পৃহ। কেন তারা এ রকম, তা আমরা জানি না। শুধু জানি, এক কঠিন লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে পার করছি সময়। তোমাকে নিরাপদে রাখার, অক্ষত, সুন্দর রাখার এই লড়াই। মাগো, এই লড়াই তো বহুকাল ধরে করে আসছে মেয়েরা, মায়েরা। তবু লড়াই তো শেষ হয় না। কিন্তু আমি আজ উপলব্ধি করি, অনুভব করি, আমার সামান্য অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝতে পারি, লড়াইয়ের দিক বদলাবার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। পাল্টে ফেলতে হবে রণকৌশল, বদলাতে হবে অস্ত্র। তা না হলে, এই লড়াই জেতা আজ কঠিন। মান্ধাতা আমলের অস্ত্র আর কৌশল খাটিয়ে শত্রুকে ধরাশায়ী করতে তো পারবই না। বরং পিছিয়ে যাব আরও বেশি, আহত হব, রক্তাক্ত হতেই থাকব, কিন্তু অর্জন হবে না কিছুই।

আজ নিজেদের আত্মবিশ্বাসকে শক্তিতে পরিণত করে বীরদর্পে সামনে এগিয়ে যাওয়াটাই সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। কোনোভাবেই মাথানত করার কোনো সুযোগ আর নেই। নিজেকে কম শক্তিমান, কম ক্ষমতাবান, কমযোগ্য, কম মেধাবী ভাবার কোনো অবকাশ নেই। লিঙ্গকে কেন্দ্র করে যারা তোমাকে দমিয়ে রাখতে চাইবে, পীড়ন, শোষণ করতে চাইবে, তাদেও বিরুদ্ধে লড়াই করেই চলতে হবে পথ। মাগো, এর চেয়ে বড় আফসোসের আর কিছুই নেই যে, এই নারী জীবনের একটা বিরাট সময় তোমার চলে যাবে এই লড়াইটার পেছনে, কিন্তু অর্জন আসবে খুব ধীরে, খুব কষ্টে। কিন্তু মা, মামণি আমার, হেরে যাবার প্রশ্নই আসে না, থেমে যাবারও নয়। তোমাকে লড়াই করতেই হবে, ঠিক যেমনটা করেছি আমি, করেছেন তোমার নানুমণি, তোমার দিদা, তোমার খালামণিরা। তবে হ্যাঁ, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে লড়াইয়ের কৌশলে পরিবর্তন আসবে, আসবেই। সেই পরিবর্তনটা কেমন আর কীভাবে, সেটা তুমি নিজেই একদিন ধরতে পারবে, আর আয়ত্ত করে নেবে।

মামণি আমার,
তোমাকে অনেক সুন্দর কিছু কথা বলতে চেয়েছিলাম। ধরো কোন ঘাসফুল, কি প্রজাপতি, কিংবা কোন লাল বেলুনের গল্প করতে চেয়েছিলাম। তোমার মতো একটা ছোট্ট নরম তুলতুলে বাচ্চার জন্য এই তো স্বাভাবিক। আর আমার কাছে তুমি তো স্বর্গ থেকে নেমে আসা ছোট্ট সোনাপরি। তবু দেখো, কী আশ্চর্য, আজ তোমাকে লিখতে বসে আমি শুধু কঠিন কঠিন শব্দ আর বাক্যই লিখে যাচ্ছি পাতার পর পাতা। কী অবাক করা ব্যাপার! কী করব বল মা! আজ এই দুনিয়াটাই এমন প্রাণহীন, কোমলতাহীন, কর্কশ আর রুক্ষ হয়ে উঠেছে আমাদের সব পথ, সব মত, সব জীবনযাপন এসে মিলেছে সেই অসুন্দর আর অন্ধকারের সীমান্ত ঘেঁষে। সেখানটাতেই লড়াই চলছে তুমুল। সেই লড়াইয়ে আমি- তোমার মা, আজ রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত। তবু থামবার উপায় নেই। যুদ্ধ করেই চলেছি। এই যুদ্ধ তো শেষ হবার নয়।

মাগো আমার,
তুমি স্কুলে যাচ্ছো, নাচছ, গাইছ, ছবি আঁকছ। আমি চেয়েছি আনন্দ আর ভালোবাসা নিয়ে তুমি তোমার ভালো লাগার বিষয়গুলোর চর্চা করো। আমি চেয়েছি আমাদের বাংলা ভাষা, আমাদের বহুকালের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি আর শিল্প-সাহিত্যকে তুমি জানো। আমি চেয়েছি বাংলা ভাষা আর সংস্কৃতিকে তুমি প্রাণে ধারণ কর। ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়েও তা করা সম্ভব, যদি তুমি ভালোবাসো নিজের দেশকে, নিজের মাটিকে।
অতন্দ্রিলা, আমি চাই তুমি ইতিহাস পাঠ করো। নিজের দেশের ইতিহাস, বিশ্বের ইতিহাস। আমি চাই তুমি একজন রাজনীতিসচেতন মুক্ত মানুষ হয়ে ওঠো। আর এ জন্য সবার আগে যা প্রয়োজন তা হলো পড়া, অনেক অনেক পড়তে হবে। আমাদের বাড়িতে কোনো দামি আসবাব নেই, অনেক মূল্যবান জিনিসপত্রও নেই, অনেক অনেক অর্থসম্পদ কিছুই হয়তো আমি ও তোমার বাবা তোমাকে দিয়ে যেতে পারব না। কিন্তু মা, জন্মের পর থেকেই এই বাড়িতে একটা ছোট্ট, ছায়াঘেরা পড়ার ঘর তোমাকে উপহার দিতে পেরেছি। চার-পাঁচটি আলমারি ভরা বই তোমার চোখের সামনে সাজিয়ে রাখতে পেরেছি। এই বইগুলো তোমার। তোমার যখন ইচ্ছে যে বইটা ইচ্ছে তুমি নামিয়ে নিয়ে ছুঁয়ে দেখতে পারো, চোখের সামনে খুলে ধরতে পারো, পাঠ করতে পারো। পড়াশোনার জগতে তুমি স্বাধীন, মুক্ত পাখির মতো বিচরণ করবে, এই আমার স্বপ্ন, এই আমাদের প্রত্যাশা। এই সাড়ে তিন বছর বয়সে তোমার নিজেরও বইয়ের একটা সংগ্রহ গড়ে উঠেছে। ইংরেজি ও বাংলা ছবিওয়ালা বইয়ে ভরে গেছে তোমার ঘর। আমার ভারি ভালো লাগে মা তোমার ওই ছোট্ট লাইব্রেরিটা দেখতে, যখন তুমি নিজের বইগুলো ঘেঁটে নিজে পছন্দ করে নাও কোন একটি বই আর আমার কাছে এসে বল, ‘মাম্মা, পড়ে দাও এই বইটা’ আমার কী যে আনন্দ হয়, তা তোমাকে বলে বোঝাতে পারব না।

তুমি মোবাইল ফোন চেনোনি, সারাদিন টেলিভিশনের পর্দায় বুঁদ হয়ে থাকতে শেখোনি। নিজের জগতে শিশুতোষ খেলনা আর বইখাতা রংপেনসিল নিয়েই বড় হচ্ছো তুমি। ঠিক যে রকম আমাদের শৈশবে আমরা বড় হয়েছি। পার্থক্য শুধু একটাই, তোমাকে একটা দিগন্তজোড়া খেলার মাঠ আমি উপহার দিতে পারিনি। এ আমার চরম অক্ষমতা। এই ইট কাঠে ঘেরা কঠিন শহরে নিরাপদে স্বস্তিতে তোমাকে খেলতে পাঠানোর মতো কোনো মাঠ নেই আমার হাতের কাছে। অথচ দেখো, ছেলেবেলায় বিকেল মানেই আমরা দৌড়াতাম মাঠজুড়ে, হাডুডু, কানামাছি, ছিবুড়ি- কী না খেলেছি! সারা বিকেল দৌড়ে দৌড়ে কোথায় কোথায় হারিয়ে গিয়েছি সঙ্গী সাথিদের সঙ্গে। সন্ধ্যায় ঘরে ফিরলে মা হাত-মুখ ধুয়ে নাশতা দিয়েছেন- দুধ ভাত কলা। আহ্, সেকি স্বাদ। মাগো, আজ সেই মাঠ নেই, সঙ্গীসাথি নেই, সেই দুধ ভাত কলাও নেই। এভাবেই বুঝি সময় পাল্টে যায়। কেন যে এমন হয়, কে জানে!
আমি তাও চেষ্টা করি। যখনই সময় পেয়েছি আমরা এই ঢাকা শহর ছেড়ে চলে গেছি দূরে কোথাও। বেরিয়ে এসেছি। আমি চেয়েছি তুমি খোলা মাঠে ময়দানে দৌড়াও, ছোটাছুটি কর। বিড়ালছানা, কুকুর ছানাকে জড়িয়ে ধরে আদর করো। ঢাকায় আমাদের বাড়ির ছাদটা বিশাল। প্রায় প্রতি বিকেলেই সেখানে তুমি বল নিয়ে খেলো, সাইকেল চালাও। সেই সময়টা আমি তোমার ঝলমলে মুখখানা দেখি। আমার বুক ভরে যায় আনন্দে।

আমার অতন সোনা,
রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে তুমি যখন আমার বুকে মুখ লুকিয়ে বল, ‘মা আমি তোমাকে ভালোবাসি’, খেলতে খেলতে ক্লান্ত হয়ে যখন তুমি আমাকে বল, ‘তোমাকে অনেক ভালোবাসি মা’, আমার সারা দিনের সব ক্লান্তি, বেদনা, বিপন্নতা সব ঝরে যায়, উড়ে যায় কোন হাওয়ায়। তোমার চেয়ে মূল্যবান আমার জীবনে আর কিছু নেই। তোমার বাবার ক্ষেত্রেও তাই। তোমার জন্য সবচেয়ে ভালো জিনিসটিই তিনি নিয়ে আসতে চান, তোমাকে মানুষের মতো মানুষ করে গড়তে নিজের সর্বস্ব দিয়ে চেষ্টা করেন। আর ঈশ্বরের কী অসীম মহিমা, তুমিও আমাদের বুকের ভেতরে একটা লক্ষ্মী প্রতিমার মতো মিষ্টি অবয়ব নিয়ে বেড়ে উঠছ। তোমাকে দেখেই সবার বুক স্নেহে ভরে যায়।
যখন এসব ভাবি, তখন আবারও মনে পড়ে সেসব দিনের কথা, যখন তুমি ছিলে আমার পেটের ভেতরে, আমার জরায়ুর গভীরে। তখন দিনরাত আমি শুধু এই প্রার্থনাই করেছি, হে ঈশ্বর, যে আসবে এই পৃথিবীতে সে যেন সত্যিকার মানুষ হয় একজন, যার হাত কল্যাণ বয়ে আনবে জগতে, যার মুখ দেখলেই শান্তির সুবাতাস বয়ে যাবে চারপাশে।

মামণি আমার,
আমি সেই প্রার্থনা ভুলিনি। আজও প্রতি মুহূর্তে তোমার জন্য এই প্রার্থনাই আমি করি। এই পৃথিবীতে আমাদের প্রত্যেকের জন্ম কোনো না কোনো উদ্দেশ্য সাধনে ঘটেছে। আমি বিশ্বাস করি, তোমার অস্তিত্ব একদিন এই পৃথিবীর শুভ ও কল্যাণকর কাজে নিয়োজিত হবে। তুমি শান্তির পথ দেখাবে, তুমি আনন্দ আর ভালোবাসার বার্তা পৌঁছে দেবে মানুষের ঘরে ঘরে। আর আমার চেষ্টা থাকবে তোমাকে সেভাবে গড়ে তোলার, সেভাবে বড় করার। পরম করুণাময়ের কাছে আমি সেই শক্তি চাই, সেই আশীর্বাদ প্রার্থনা করি।

আম্মু,
আজ বড় দুঃসময়। তোমাকে লেখা চিঠিটা অর্ধেক লিখে উঠে যেতে হলো। শাহবাগে প্রতিবাদ সমাবেশে যোগ দিতে গেলাম। সুপ্রিম কোর্টের সামনে স্থাপিত ন্যায়ের প্রতীক নারীর ভাস্কর্যটি সরিয়ে দেওয়া হয়েছে একদল মৌলবাদীর অন্যায় দাবি মেনে নিয়ে। কেন এই আপস, কী সেই রাজনৈতিক কৌশল, তা আমাদের সাধারণ মানুষের মাথায় ঢোকে না। শুধু জানি, আমাদের হাজার বছরের সংস্কৃতি আর প্রগতিশীল চেতনাকে একটা বড়সড় আঘাত করা হয়েছে। চরম অবমাননা করা হয়েছে নারীকেও। এর বিরুদ্ধে যদি ফুঁসে না উঠি, তবে তো কোনো দিন নিজের মুখোমুখি দাঁড়াতে পারব না। নিজের বিবেকের কাছে ছোট হয়ে যাব। তাই সমাবেশে যেতে হলো।

অতন্দ্রিলা, মা,
আমি চাই তুমি দেশ আর দেশের মানুষের পাশে থাকো, দেশের প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে সম্পৃক্ত হও। আমি চাই তুমি সচেতন থাকো নিজের অধিকারের প্রতি, নিজের অস্তিত্বের লড়াইয়ের প্রতি।

অতন্দ্রিলা আকাশলীনা আমার,
অমিয় চক্রবর্তীর ‘রাত্রি’ কবিতাটা থেকে তোমার অতন্দ্রিলা নামটি বেছে নিয়েছিলাম। তোমার চাচ্চুর সঙ্গে এখনো আমার মিষ্টি লড়াই হয় কে আগে বেছে নিয়েছিল নামটা তাই নিয়ে। হা হা হা হা। আর আকাশলীনা তোমার বাবার পছন্দে রাখা নাম। জীবনানন্দের ‘আকাশলীনা’ কবিতা।

অমিয় চক্রবর্তীর ‘রাত্রি’ কবিতাটা থেকে তোমার অতন্দ্রিলা নামটি বেছে নিয়েছিলাম। তোমার চাচ্চুর সঙ্গে এখনো আমার মিষ্টি লড়াই হয় কে আগে বেছে নিয়েছিল নামটা তাই নিয়ে। হা হা হা হা। আর আকাশলীনা তোমার বাবার পছন্দে রাখা নাম। জীবনানন্দের ‘আকাশলীনা’ কবিতা।

মাগো, একদিন তুমি এই দুটো কবিতাই পড়বে। শুধু তাই না, জীবনানন্দকে ভালোবাসবে তুমি, আমি ঠিক জানি। ভালোবাসবে অমিয়কে, ভালোবাসবে রবীন্দ্রনাথকে, নজরুলকে, সুকান্ত, শক্তি, বিনয়, সুভাষ, শামসুর রাহমান, আবুল হাসান, শহীদ কাদরী, রফিক আজাদ, রণজিৎ দাশ, জয় গোস্বামীকে। ভালোবাসবে ইয়েটস, বোদলেয়ার, ভালোবাসবে শেক্সপিয়ার, তলস্তয়, চেখভ, ম্যাক্সিম গোর্কিকে। আমার যতটা সাধ্য আমি গড়ে তুলব তোমাকে। পৃথিবীটা এত সুন্দর, এত আলো ঝলমলে- সেই পৃথিবীকে আনন্দময় ভালোবাসাভরে দেখার জন্য যে চোখ চাই, তোমার সেই দৃষ্টিটা তৈরি করার দায়িত্বটুকু আমার।

মাগো,
আদর আর ভালোবাসা তোমার জন্য। পৃথিবীতে শিশুর চেয়ে সুন্দর আর কিছু নাই। পথ দিয়ে যেতে যেতে যে ছিন্নমূল বাচ্চাদের দেখি ছেঁড়া কাপড়ে, ধুলোয় ময়লায় গড়াগড়ি খায়, গাড়ির জানালার পাশে এসে হাত বাড়ায়, তাদের জন্য আমার সীমিত সামর্থ্যে আমি কিছুই করতে পারি না। কিন্তু বিশ্বাস করি, একদিন এই শিশুদের জন্য একটা সুন্দর পৃথিবী গড়ে উঠবে। প্রত্যেক বাচ্চা বইয়ের ব্যাগ ঘাড়ে ঝুলিয়ে স্কুলে যাবে। মায়ের কোলে নিশ্চিন্তে ঘুমোবে। পৃথিবীর কোথাও কোন শিশুকে বোমার আঘাতে প্রাণ হারাতে হবে না, মর্টারশেল থেকে পালিয়ে পালিয়ে বাঁচতে হবে না, নিজের দেশ ছেড়ে সমুদ্রে ভেসে যেতে হবে না। মাগো, কবে আসবে সেই দিন? কবে পাব সেই পৃথিবীকে? কবে আমাদের মতো উৎকট বড়রা যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা বন্ধ করবে চিরতরে? কবে আমরা তোমাদের জন্য এনে দেব একরাশ ফুলের পৃথিবী?

আমি জানি না। কিন্তু আমার স্বপ্ন তো থেমে নেই। আমার বিশ্বাস তো ভেঙে যায়নি। আমার সেই স্বপ্ন আর বিশ্বাসকে আমি তোমার ভেতরে প্রবাহিত করে দিয়ে যেতে চাই। আমি চাই, তুমি সেই ভালোবাসার বার্তা আর স্বপ্ন নিয়ে জেগে ওঠো, জাগিয়ে তোলো আরও মানুষকে। তোমার সব কাজে আমার অকুণ্ঠ সমর্থন, আমার ভালোবাসা সব সময় জেগে থাকবে মা। দূরে কাছে যেখানেই থাকো, জেনে রেখো, মাম্মা তোমার বুকের ভেতরে, তোমার অস্তিত্বের খুব কাছে আছে। তোমাকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে আছে। তোমার হৃৎপি-ের প্রতিটি ধ্বনির ভেতরে আছে। কারণ তুমি আমার, আমার অস্তিত্ব আমার শরীরের একটা মূল্যবান অংশ তুমি। তুমিই আমার বেঁচে থাকা। তুমিই আমার ভালোবাসা, বিশ্বাস, আমার স্বপ্ন।

তোমার জন্য আমার আশীর্বাদ ঈশ্বরের কাছে পৌঁছে যায় প্রতিদিন। ঈশ্বর মায়েদের সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন, তাই তাদের সব প্রার্থনা পূর্ণ করেন দুই হাতে। মায়েদের জন্য ঈশ্বরের এই আদিম গোপন পক্ষপাত- অতন্দ্রিলা মামণি আমার, তুমি কি এটা জানো?
ইতি
তোমার মা

লেখা: শারমিন শামস্

Comments to: মায়ের চিঠি অতন্দ্রিলাকে

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    Attach images - Only PNG, JPG, JPEG and GIF are supported.

    Login

    Welcome to Chithipotro

    You are couple of steps away from being one of our family member
    Join Us