প্রিয় রূপকথা, শুভ জন্মদিন! শুভ সুইট সিক্সটিন! বাংলায় যাকে ষোড়শী বলা হয়ে থাকে — আজ তুমি তা-ই। হায়! কতো কতো দিন ফুরিয়ে গেলো আর তুমিও বড় হয়ে গেলে। আমি ভাবি, তোমার এই ‘‘বড়ো হওয়া’’ দেখতে কতো সুন্দর। তবু আমি ফিরে যাই তোমার ছোট্টবেলার কাছে।
বারবার কান পাতি তোমার বলা অস্ফুট শব্দগুলোর কাছে — যেসব শব্দ দিয়ে তুমি তোমার পৃথিবীকে বুঝতে চাইতে, ব্যাখ্যা করতে চাইতে। হয়তো পৃথিবীর কানে কানে বলতে চাইতে তোমার কোনো ভাষা। আজ তোমার কণ্ঠে অনেক অনেক শব্দ, অনেক অনেক ভাষা।
আমি তবু পাখির বাচ্চার মতো বেরিয়ে আসা শব্দগুলোর কথা ভাবি। বা-বা.. বা.. বা.. বা… এইসব শুনে আমি মিলিয়ে নিতাম, তুমি যেন ঠিক ‘বাবা’ই বলেছো। হয়তো বলো নি, কিন্তু মনে হতো, এই বুঝি ‘বাবা’ ডাকলে।
আমার মনের ভেতর অসীম এক আনন্দ হতো।আমি তোমার সেই চুলগুলোর কথা ভাবি; ঘন, কালো, লালচে সেই চুলগুলোর সঙ্গে আমার ছোটবেলার চুলের খুব মিল ছিল। আরও ছোটবেলায় তুমি যখন স্কুলে যাওয়া শুরু করলে, তুমি তোমার চুল বেঁধে দিতে বলতে। কিন্তু আমি কখনোই তোমার চুলগুলোকে ক্লিপ কিংবা রিবন দিয়ে আটকে দিতে পারতাম না।
তুমি বলতে, ‘বাবা, তুমি কিচ্ছু পারো না।’এই সেদিন তুমি বললে, ‘বাবা, দেখি তো তুমি বেনি করতে পারো কিনা!’ আমি তোমার চুল মুঠো করে বেনি বাঁধবার চেষ্টা করলাম। হলো না। তুমি খুব হাসলে। কারণ তুমি এখন চুল বাঁধা শিখে গেছো।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তুমি যখন চুল আঁচড়াও, বিভিন্ন ভঙ্গিতে চুল বাঁধো, আমি চুপচাপ খেয়াল করি; তুমি বড়ো হচ্ছো, কিংবা বড়ো হয়ে গেছো। তোমার চুলেরা চলে গেছে তোমার নিয়ন্ত্রণে। তুমি কি জানো আমি তোমার চুলের গন্ধ নিতে কতোটা ভালোবাসি! জানো না।আমার মনে পড়ে সেই সব বৃষ্টিদিনের কথা।
বৃষ্টি এলেই তুমি বলতে, ‘বাবা, বৃষ্টি নামছে। চলো ছাদে যাই।’ ছাদে গিয়ে আমরা বৃষ্টিতে ভিজতাম। কতো দিন হয়ে গেলো আমরা আর মিছামিছি বৃষ্টিতে ভিজি না। একবার খুব শিলাবৃষ্টি হলো। সাদা শিলায় ভরে গেলো বাসার সামনের সবুজ মাঠ। রাশি রাশি শিলা দেখে সে কি বিস্ময় ছিল তোমার চোখেমুখে।
তোমার মনে হচ্ছিল, এগুলো আইসক্রিম। তুমি বলছিলে, ‘বাবা, খাওয়া যাবে?’কতো কতো প্রশ্ন ছিল তোমার মনে : কী করে মেঘ হয়? কেন বৃষ্টি হয়? পাখিরা কোথায় যায়? পাখিদের বাবা-মা কোথায় থাকে? গাছেরা কেন কথা বলতে পারে না?
আমি তোমার সব প্রশ্নের জবাব দেবার চেষ্টা করতাম। কিন্তু তোমার মনে আরও অনেক প্রশ্ন থেকে যেত। আমার দুঃখ, এখন তুমি আর আমাকে খুব একটা প্রশ্ন করো না। এইসব প্রশ্নের সবগুলোই তোমার জানা।
বরং আমিই তোমাকে বোকা-বোকা প্রশ্ন করি : রূপ, কী গান শোনো এই সব…!!!’ তুমি হয়তো বলো, ‘কে-পপ? বিটিএস!’ আমি হয়তো বলি, ‘ওহ! তুমিও কি বিটিএস আর্মি?’ তুমি হয়তো বলো, ‘তুমি বিটিএসের কথা জানো!’
আমি বলি, ‘হ্যাঁ, জানি তো !‘ দুষ্টুমি করে বলি, ‘মেয়েদের মতো দেখতে ওই ছেলেগুলো তো? ওরা নাকি বাংলাদেশে আসতে পারে! কোথায় যেন পড়লাম!’ তুমি বললে, ‘বাবা, তুমিও! ওরা তো মেইক আপ করে! কোরিয়ানরা এ রকমই!… এত টাকা দিয়ে ওদের বাংলাদেশে কেউ আনতে পারবে না।’ আমি বলি, ‘ওহ! কিন্তু তুমি তো ছায়ানটে গান শেখো।
বিটিএস আর ছায়ানট — সমস্যা হবে না। তুমি বললে, এখন প্রায় সবাই বিটিএস শোনে। তুমি কিচ্ছু জানো না।’আমার মনে পড়ে, ছোট ছোট আঙুল দিয়ে খুব কষ্টে তুমি হারমোনিয়াম বাজানোর চেষ্টা করতে। আঙুল ফসকে যেত। এখন আমি তোমার গলা সাধা শুনি।
মোবাইলে সেতার বাজে। তোমার গলায় রবীন্দ্রনাথ বাজেন। কিংবা বেজে ওঠেন নজরুল। অমল ধবল পাল উড়িয়ে তুমি গান গাও। পাহাড়ে হেলান দিয়ে তুমি গান গাও।এক সময় তুমি নাচতে। খুব সুন্দর একজোড়া ঘুঙুর ছিল তোমার। কীভাবে কখন যেন চলে গেলে একেবারে গানের দিকে। আমি অবশ্য জানি, নাচের দিকেই ছিল তোমার বেশি ঝোঁক।
দরোজা খানিকটা চাপিয়ে দিয়ে এখনও তুমি নাচো। কিন্তু আগের মতো করে তোমার নাচ আমি আর দেখতে পাই না। তবে নোরা ফাতেহির শেষতম নাচ ও গান সম্পর্কে আমাদের আলাপ হয়। কী বিচিত্র! তাই না রূপ?আমি তোমার অনেক কথাই জানি না, জানবো না কোনো দিন।
কারণ তুমি আর সেই ছোট্ট পুতুলটি নেই। তোমার মুখ জুড়ে ফোটে না আধো আধো বোলের গল্প। তোমার গল্পের পৃথিবীতে ধীরে ধীরে জড়ো হচ্ছে অনেক চরিত্রের ভিড়। যতো বড় হবে, ততো বেড়ে যাবে এই ভিড়। তখন?
আমি হয়তো তখনও তোমাকে খুঁজবো — ছোট হাত, ছোট পা, ছোট জুতা, হাসি, চুলের মিষ্টি গন্ধ; তখনও আমি হয়তো তোমাকেই খুঁজবো — যার রংপেন্সিলে আঁকা আমার এই জীবন বরাবরই সুন্দর আর রঙিন! শুভ জন্মদিন! অনেক অনেক আদর তোমাকে।
ইতি
বাবা
২৮ নভেম্বর ২০২২
অরুণাপল্লী
লিখেছেন: সুমন সাজ্জাদ
অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, জাবি
No Comments
Leave a comment Cancel