সেদিন ছিল ১৪ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার। পালিয়ে যাওয়ার জন্য এই দিনটিই তোমার প্রিয় বলে মনে হয়েছিল। কারণ আমি একটু বেখাপ্পা হলেও তুমি আমাদের বিশেষ দিনগুলোর বিষয়ে খুবই গোছালো ছিলে।
প্রতিটি উৎসব (ভালবাসা দিবস, ফাল্গুন, পহেলা বৈশাখ, বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, জন্মদিন) আমাদের ভালোবাসার সূচনার দিনগুলো তুমি যত্ন করে পালন করতে দশের অগোচরে।
আমার মতো ব্যাকডেটেড এর হাত ধরে। নিজে নতুন নতুন রঙের শাড়িতে জড়িয়ে, বেলি ফুলের গহনায় সেজে খুব যত্ন করেই আমাদের স্মৃতিগুলোকে সজীবতায় ভরিয়ে দিতে।
তোমার চঞ্চল ভালোবাসায় আমি এতটাই সিক্ত হয়েছিলাম যেখানে আমার সর্বস্ব জুড়ে তুমি নামক এক অশরীরী ছেয়ে বসেছিল আমার উপর। আমার মনে হতো আমি তোমাকে তোমার উপস্থিতিতে যতটা ভালোবাসতে পারতাম, তোমার অনুপস্থিতে তার থেকেও বেশি অনুভব করতাম।
“নীলু” নামের তুমি আমার অস্তিত্বের শিরায় উপশিরায় মিশে গিয়েছিল। তাইতো তুমি আমার ব্যক্তি সত্ত্বার কয়েক ধাপ উপরে অবস্থান করতে।
তাইতো সেইদিন তোমার বাবার হঠাৎ ছেলে দেখাদেখির খবর পেয়ে ছোট্ট শিশুর মতো তোমাকে জড়িয়ে ধরেই কেঁদে ফেলেছিলাম, “নিলু আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না। যে কোনো মূল্যেই হোক তুমি আমার হয়ে যাও, নিজের জীবনের বিনিময়ে হলেও তোমাকে তোমার চিন্তাশক্তির উর্ধ্বে ভালোবাসায় আবৃত রাখবো।”
এক গাল হেসে আমার গালটা টিপে বলেছিলে, “এই পাগল ছেলে এইভাবে কেউ কাঁদে নাকি? বাবা কেবল বিয়ের জন্য পাত্র দেখেছে তার মানে তো এইটা না যে আমার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। অমন তো আসতেই থাকে। আমি মত না দিলে কিছুই হবে না, আর আমাকে তোমার থেকে কেউ আলাদা করতে পারবে না।”
নীলুর কথায় কিছুটা সস্তি পেয়ে আমি আবার আগের মতো নীলুকে ভালোবাসতে লাগলাম, নীলুর গতিতে, নীলুর নিয়মে, নীলুর সূত্রে। আমি এক বাধ্য শীর্ষের মতো আমার ভালোবাসার চর্চা চালাতে লাগলাম।
কিন্তু হঠাৎ এক অভিশপ্ত সন্ধ্যায় ছাত্রের বাসায় থাকতে ফোন এলো নীলুর নাম্বার থেকে। ফোন ধরতেই কান্না জড়িত কণ্ঠে নীলু বললো, “অবস্থা খুবই শোচনীয়, তুমি তোমার প্রয়োজনীয় সবকিছু নিয়ে বের হও। আজকে ১৪ তারিখ, আজকে রাতেই আমরা পালিয়ে যাবো।”
কাঁপতে কাঁপতে ছাত্রের বাসা থেকে কোনো কিছু না বলেই দৌড়ে বেরিয়ে এলাম। মেসে আমার ব্যাবহৃত কিছু কাপড়, প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস আর আমার সঞ্চিত ৮,০০০ টাকা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম নীলুর বলা গন্তব্যস্থল “কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে।”
সেদিন কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের সব কয়টা ট্রেনের আসা যাওয়া দেখেছিলাম আমি। সেদিন শুধু আমার আর নীলুর নামে টিকিট কাটা হয়নি।
চটি পায়ে, সাথে একটা ব্যাগ নিয়ে, একা আমি শুধু মানুষের গন্তব্যের তরে ছুটে চলাই দেখেছিলাম। সেদিন আমার ট্রেনটা এলো না! আমার গন্তব্যের সন্ধান আমি পেলাম না।
সেদিন শুধু মোটা চশমার কাঁচটা অযাচিত নোনতা পানিতে ঝাপসা হয়েছিল, আর এক কোটিবার একটা বন্ধ নাম্বারে ফোন দেওয়া হয়েছিল।
আজ ১৫ বছর পর ১৪ ফেব্রুয়ারি,
এইদিনের পর থেকে আমার জীবনের পনেরোটা বছর ধরে একই বাক্যে, আমার জীবনের একটা ছোট্ট গল্প ডায়েরির পাতায় লিখে যাই।
নীলু? পনেরোটি বছর হয়ে গেল, সেদিনের পর থেকে তোমার সাথে আমার আর কখনোই দেখা হয়নি। হয়তো প্রকৃতি জেনেছে আমাদের দেখা হওয়া অনুচিত। প্রকৃতি চায়নি তোমার অযোগ্য অতীত তোমার সামনে আরো একটি বার আসুক!
প্রকৃতি তো তার নিয়মেই চলে। কেউ প্রকৃতির নিয়মে আরো উজ্জ্বল নক্ষত্রের পানে ছুটে যায়, কেউবা প্রকৃতির নিয়মে নিকষ কালো রাতের অন্ধকারে হারিয়ে যায় অথবা কেউ সফলতার স্বর্ণশিখরে আহরণ করেও এক অজানা অন্ধকারের মায়ায় মাখিয়ে থাকে, আঁধারের সহযাত্রী হয়ে…।
ইতি,
নীলুর অযোগ্য অতীত
লেখা: তাসনিয়া অন্তি
No Comments
Leave a comment Cancel