তোমাকে যখন লিখছি ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে বাইরে। উত্তরের জানালা দিয়ে সে বাতাস আমাদের সেই ‘আপন আলোয়’-তে প্রবেশ করে দক্ষিণ দিক দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। বাতাসের সাথে সুগন্ধ মিশ্রিত থাকায় ধারণা করছি ছাদে বোধহয় ফুল ফুটেছে। কাজের চাপে বহুদিন ছাদে যাওয়া হয় না।
আগে তো প্রতিদিনই বাবুকে নিয়ে ছাদে যেতাম। আঙুল উঁচিয়ে ওকে নাম না জানা উড়ন্ত পাখি দেখাতাম, ফুলের গাছে থাকা প্রজাপতির পেছন পেছন ছুটতাম, কবুতরের খোপের কাছে গিয়ে খাবার দিতাম।
প্রমোশনের পর বাসায় ফিরতেই রাত হয়ে যায়, ছাদে আর যাওয়া হয় না তেমন। অবশ্য ঘুম না আসলে বা মাঝরাতে কোনদিন ঘুম ভেঙে গেলে তোমার দেয়া গেরুয়া শালটা গায়ে জড়িয়ে ছাদের ইজি চেয়ারে বসে থাকি, তারা গণনা করি। একটা সময়ে বহু চেষ্টা করেও সিগারেট টানতে পারিনি, বন্ধুমহলে হাসির খোরাক জুগিয়েছি কতবার। আর এখন সিগারেট দিয়েই শুরু হয় দিন, শেষও হয় ওভাবে!
আজ আমার জীবনে এক মহা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে, সেটার অবতারণা করতেই বহুদিন পর লিখতে বসেছি। যদিও জানিনা চিঠিখানা তুমি পাবে কিনা। কিছুক্ষণ আগে তোমার বান্ধবী নিরুপমার কাছ থেকে তোমার ঠিকানা সংগ্রহ করেছি। উনি যে লোকেশন বলে দিয়েছেন ঠিক সেখানেই তুমি আছো কিনা তাও জানিনা।
চলে যাবার আগে ‘জীবনের কোনো কিছুই অপরিহার্য নয়’- শিরোনামে যে নাতিদীর্ঘ চিঠি টেবিলের উপর রেখে গিয়েছিলে তুমি, আমি সেটা সযত্নে বাঁধিয়ে রেখেছি। দ্বিমত থাকা সত্ত্বেও তোমার ইচ্ছে বা মতকে সম্মান জানিয়েছি সবসময়। মাতৃত্বের সুতীব্র আবেদনে তুমি বেশিদিন সাড়া না দিলেও বাবু আমার জীবনের অপরিহার্য অংশ হয়ে গেছে সেই কবেই।
জানো, মাঝেমাঝেই পেছনের দিনগুলোর কথা আমার মনে পড়ে যায়। আমাদের প্রেমের সময়গুলো পুষ্পশোভিত হলেও বিয়ের পরে শুরুর দিনগুলোতে ছিলো রোজকার তেল-লবণের দায়। দেশীয় কোম্পানিতে ছোটখাটো একটা চাকরি ছিলো, যা বেতন পেতাম তার সিংহভাগই চলে যেত বাসা ভাড়া আর আনুষঙ্গিক অন্যান্য খরচে। নতুন পোশাক বলতে উপলক্ষ্য ওই দুই ঈদ। বাইরে খেতে যাওয়া, সিনেমা হলে যাওয়া, জন্মদিন-বিবাহবার্ষিকী উদযাপনের কথা ভাবা তখন রীতিমত আদিখ্যেতা।
সবকিছু মিলিয়ে তোমার চাপা বেদনা আমি টের পেতাম প্রতিনিয়ত, নিজেকে খুব অসহায় মনে হতো জানো। তবুও দিনশেষে ঘরে ফিরে তোমার হাসিমুখ দেখে নতুন স্বপ্ন দেখতাম, তুমি বলতে ‘দেখো, সব ঠিক হয়ে যাবে, একদিন আমাদেরও সব হবে’।
সব ঠিক হয় না কখোনোই প্রিয়তমা। বেদনা আর অতৃপ্তির অমোচনীয় আলপনা সবসময় হৃদয়জুড়ে থাকে সেটা তুমিও জানতে। এই যে স্বার্থপরের মতো তোমার চলে যাওয়া প্রতিনিয়ত আমাকে অপরাধী করে, বেদনার্ত করে, সেটা কী তুমি টের পাও? অভাব আমাদের ছিলো সত্য, কিন্তু ভালোবাসার চাদরে মুড়ে সবকিছুই তো ঠিকঠাকমতো চলছিলো। এরই মাঝে আমাদের ছোট্ট সংসার আলোকিত করে এলো আমাদের সন্তান, আমাদের বাবু।
তারপর তো ওকে ঘিরেই শুরু হলো আমাদের নতুন জীবন, নতুন যুদ্ধ। টাকা-পয়সা না থাকলেও শিক্ষা, প্রশিক্ষণের মতো অবিনশ্বর পুঁজি আমার ছিলো। অথচ যেদিন কোম্পানি দেউলিয়া হয়ে চাকরিটা চলে গেল এসবের কিছুই কাজে আসেনি। নির্মম এক বাস্তবতায় নিপতিত হয়ে কতবার যে আত্মসম্মান জলাঞ্জলি দিয়েছি তারও ইয়ত্তা নেই।
তোমার পরিবার বিশেষ করে তোমার বাবা আমাদের সম্পর্কটাকে সহজভাবে মেনে নেননি কোনদিনই। হয়তো আমার আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণেই।
এরই মাঝে বাবু একদিন ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লো। ডাক্তার জানালেন আমাদের প্রিয় লক্ষ্মী সোনাটা ‘বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন’ , ও স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে এমনকি কথাও বলতে পারবে না। অজানা উৎকণ্ঠায় সেদিন আমরা হতবিহ্বল হয়ে পড়েছিলাম। একসময় জেনে গেল তোমার পরিবারও। তোমার বাবা সেদিন ফোনে তোমাকে কী বলেছিলেন জানিনা। তারপর কোনকিছু না ভেবেই তুমি চলে গেলে!
জানো, আজকে অফিস থেকে ফিরে বাবুকে যখন কোলে নিয়েছি তখন সে হঠাৎ ‘মা’ বলে ডেকে উঠেছে! কোথা থেকে এই ডাক শিখলো শুরুতে আমার মাথায় আসেনি। মাস দুয়েক হলো বড় আপা ট্রেনিংয়ের জন্য আমাদের এখানে থাকছেন। ছোট ভাগ্নে তাহজিব আপাকে ছাড়া কিচ্ছু বোঝে না, সারাক্ষণ ‘মা’ ডাকতে থাকে। সম্ভবত সেখান থেকেই শিখেছে বাবু। ‘মা’ কে খুঁজে না পেয়ে দাদির কোলে চড়ে সেখানেই ঘুমিয়ে পড়েছে শেষমেশ। ভীষণরকম বাস্তববাদী আমিও আনন্দ-বেদনার মিশ্র অনুভূতিতে আচ্ছন্ন। আঙুল ধরে থাকলে আমাদের বাবাই একটু-আধটু হাঁটতেও পারে। গতকাল সোফার উপরে কিছুক্ষণ হাঁটিয়েছি। চিকিৎসকের কথামতো ওর যথাসাধ্য যত্ন নিচ্ছি আমরা।
এখন মাঝরাত। ঘুম আসছে না কিছুতেই। ছাদেও যেতে ইচ্ছে করছে না। অনেক টাকা বেতনের চাকরি করি, গাড়ি-বাড়ি সবকিছুই হয়েছে অথচ কিছুই যেন নেই আমার, একেবারে নিঃস্ব। আনমনে চেয়ে আছি ঝুলন্ত ফ্যানটার দিকে। তুমি চলে যাবার পর থেকে একবারের জন্যেও সে ঘোরে নি। জড় পদার্থ হলেও একজন জীবন্ত মানুষের ঝুলে যাওয়াকে হয়তো সে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেনি।
তোমার বাবা মামলা করেছিলেন, চৌদ্দ শিকে কাটিয়েছি বেশকিছুদিন। শুনেছি ব্যবচ্ছেদও নাকি করা হয়েছিলো তোমাকে। কী নির্মম, কী বিভৎস! আচ্ছা চিকিৎসকগণ তোমার হৃৎপিণ্ডে কিছু কী খুঁজে পেয়েছিলেন তখন? কোন অভিযোগ,হতাশা বা সুপ্ত ভালোবাসা?
কয়দিন আগে তোমার বাবা-মা একজন আইনজীবী সহকারে আমাদের বাসায় এসেছিলেন, তোমার গহনা নিতে। তাদেরকে খালি হাতে ফেরানোর সময় মাটিতে নিজেকে পুঁতে ফেলতে ইচ্ছে করছিলো। তখন এতটাই অসমর্থ ছিলাম যে স্ত্রীকে সামান্য অলংকারও কিনে দিতে পারিনি। আচ্ছা আমার প্রতি তাদের অভিযোগ বা ক্ষোভ থাকতে পারে কিন্তু বাবু? একটিবারের জন্যেও তারা বাবুকে কোলে নেন নি বা চেয়ে দেখেননি।
প্রিয়তমা, মৃত্যুর মাধ্যমেই তো জীবন থামে। মৃত্যুই তো জীবনের গন্তব্য। সে মৃত্যুকে তুমি নিজহাতে আলিঙ্গন করেছো। স্বার্থপর আমি নিজেকে প্রবোধ দিই এ ব্যাপারে। কিন্তু মাতৃত্বের মধুর স্বাদ থেকে বাবু যে বঞ্চিত হচ্ছে, এর দায় কী শুধুই আমার? মানবিক দিকটাও তো বিবেচনা করতে পারতে। তুমিই তো বলতে, ‘জাল ফেলে আলো ধরা যায় না’। সেই তুমি অন্ধকার দূর করতে আলো না জ্বালিয়ে অন্ধকারেই হারিয়ে গেলে!
তুমি যেখানে চিরনিদ্রায় শায়িত আছো, বহু কষ্টে সেই ঠিকানা তোমার বান্ধবী নিরুপমা আপার কাছ থেকে নিয়েছি সন্ধ্যায়। বাবুকে নিয়ে সকালেই ছুটে যাবো তোমার কাছে, কতদিন দেখি না! আচ্ছা, তুমি কী এখনও রজনীগন্ধা ফুল পছন্দ করো? আমার বিশ্বাস, করো। একটা সতেজ রজনীগন্ধার স্টিক নিয়ে গেলে তুমি কী সেটা গ্রহণ করবে? আর চিঠিটা?
ভালো আছো, ভালো থাকো। আমি ভালো নেই।
ইতি
তোমার খুব পরিচিত কেউ, যে শেষমেশ আনন্দ-বেদনার চিরসঙ্গী হয়ে উঠতে পারেনি।
লেখক- মোঃ জুবায়ের ইবনে কামাল
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
No Comments
Leave a comment Cancel