নুসু,

বহুদিন আগে এক সময় এ রকম একটা টেবিলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মুখে কলম গুঁজে বসে পশ্চিমের জানালা দিয়ে পড়ে আসা বিকেলে আলোদের খেলা করা দেখতাম। দেখতাম বাহিরে হামাগুড়ি দিয়ে সন্ধ্যা নামা।

আরও একটু পরে দেখতাম দলবেঁধে অন্ধকারদের বিনা অনুমতিতে আমার ঘরের ভিতরে ঢুকে পড়া। সেই সব বিকেল আর সন্ধ্যায় শব্দরা আমাকে নিয়ে খেলত, অথবা আমি খেলতাম তাদের সাথে, অথবা বলা চলে আমাদের মাঝে চলত এক শব্দহীন কানামাছি খেলা।

আস্তে আস্তে রাত গভীর হতো, লুকোচুরি খেলতে খেলতে এক সময় ক্লান্ত শব্দরা আমার ঝর্ণা কলমের ঠোঁটে মুখ ঘষত। এ যেন নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ সেই সব বাউণ্ডুলে শব্দদের!

আমি তখন লেখা শুরু করতাম, হয়ে উঠতাম অপার্থিব একজন। শেষ রাতে যখন কলম বন্ধ করতাম, বন্দী শব্দগুলোর প্রতি অপার এক মায়া জন্মাত আমার ভিতরে, তাদের রেখে ঘুমোতে যেতে পারতাম না।

আবার কখনো কখনো ভয় হতো, আমি চোখ বুজলেই তারা ডানা মেলে উড়ে যাবে, যেভাবে মুঠো খুললেই উড়ে যায় মুঠোবন্দী জোনাক পোকা।

তাই প্রতীক্ষায় থাকতাম কখন সকাল হবে, কখন আমি পাতা-বন্দী শব্দগুলোকে তোমার হাতে তুলে দেব। খুব সকালে এক দৌড়ে পৌঁছে যেতাম তোমার হোস্টেলের সামনে।

নরম কাপড় জড়িয়ে যেভাবে হাসপাতালের ধাত্রী নবজাতক শিশুকে তুলে দেয় জননীর কাছে, ঠিক সেভাবেই হলদে তিন-চারটে পাতা আমি তোমার দিকে এগিয়ে দিতাম, তুমি তখন কপট ব্যস্ততা দেখিয়ে বলতে, ‘এখন সময় নেই অত, ক্লাসে যাব। দাও আমাকে, রেখে দিচ্ছি, পরে পড়ব।’

তোমার অতল কালো চোখ দু’টো গোপন করতে পারত না তোমার ভিতরটা। আমি টের পেতাম, তোমার তর সইছে না একটুও, তুমি ভিতরে ভিতরে ব্যস্ত হয়ে উঠেছো কখন আমার লেখাটা পড়ে শেষ করবে। পড়ে-টড়ে বলতে, ‘হয়নি।

আরও ভালো লিখতে হবে।’ অথচ তোমার চোখ বলত ভিন্ন কথা, তৃপ্তির ঝিলিক আঁকা থাকত সেখানে, আর থাকত সাতরঙা ভালোবাসা। আমি দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়তাম। কোনটা বিশ্বাস করব? তোমার মুখের কথা, নাকি চোখের ভাষা! তোমার চোখে মুগ্ধতা দেখার লোভ আমাকে পেয়ে বসেছিল ভীষণ।

আমি ডুবুরি হয়ে শব্দসমুদ্রে ঝাঁপ দিতাম, সাগর সেচে মুক্তো আনার মতো করে খুঁটে কুড়িয়ে আনতাম এক একটা শব্দ, ভেজা গায়ে হয়ে উঠতাম শব্দের মালাকার, মুক্তোর মতো শব্দগুলোকে একটার পর একটা সাজিয়ে মালা গেঁথে পরিয়ে দিতাম তোমার গলায়! নুসু, বলতে পারো একপ্রকার নিস্তরঙ্গই কাটছিল আমার আটেপৌরে জীবনটা।

যখন ভাবি ভীষণ অবাক হই। হঠাৎ করেই কেমন যেন এক রোমাঞ্চকর নাটকীয়তা এলো আমার সেই স্লেটরঙা জীবনে! আজ থেকে এগারো বছর আগে এক ২৮শে ফেব্রুয়ারী সন্ধ্যায় বাংলা একাডেমীর গেটে তোমার সাথে আমার শেষ দেখা হয়েছিল, তোমাকে হারিয়ে ফেলার পর ঢাকা শহরের মানচিত্রটা বদলে গিয়েছিল যেন, ভুলে গিয়েছিলাম আমি বাংলা একাডেমী’র রাস্তা।

কত্তদিন বাদে, এ বছর, হ্যাঁ এই বছর, সেই ২৮শে ফেব্রুয়ারী সন্ধ্যায় আবার তোমার সাথে আমার দেখা হলো। লিটল ম্যাগ চত্বরের পাশে একটু আঁধারে দাঁড়িয়ে নিকোটিন-শলাকা পোড়াচ্ছিলাম আমি। সেই আধো-আলো-আধো-অন্ধকারে একপাশ থেকে মাত্র একপলক দেখেও তোমাকে আমি ঠিক চিনে ফেললাম।

ঐ চিবুকের গঠন আর কারো হতে পারে না, ছায়ামূর্তিটিকে দেখেই আমার মন বলে উঠেছিল, বিশ্বাস করো। আমার পাশ দিয়ে তুমি যখন গেলে তামাকের গন্ধ একটু সময়ের জন্য পর হলো আমার, বোধ হয় তোমাকে দেখে।

পরক্ষণেই তোমার শরীর থেকে ধেয়ে আসা সেই মাদক-সুবাস ছুঁয়ে গেল আমার স্নায়ু, টের পেলাম এগারো বছর পরেও তা আজও আমার ভীষণ রকমের চেনা। মুখ দিয়ে আচমকা বেরিয়ে এলো একটা শব্দ, ‘নুসু।’

একটু থমকালে তুমি, হয়তো ভুলেই গিয়েছিলে এটাও তোমার একটা নাম ছিল কোন এক সময়! সম্বিৎ ফিরে পেতেই ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকালে, ফিরে এলে কিছুটা আমার দিকে আলুথালু পায়ে হেঁটে, যদিও তা এগারো বছরে অতিক্রান্ত পথের সমান দূরত্ব নয় কোনভাবেই।

তবুও তো এলে! জানা হলো, তুমি এখন সংবাদপত্রে কাজ করছ, সাহিত্য পাতা দেখছ। স্বামী-সন্তান নিয়ে সংসারটা তোমার বেশ গোছানো- সাহিত্যপাতার মতো, তাও জানলাম। শেষ বেলায় কি ভেবে বলে গেলে আমাকে, ‘একটা গল্প লিখে দিও, আমার সাহিত্য পাতার জন্য।’ তাতেই হলো মুশকিল!

তোমাকে মুগ্ধ করার জন্য এক সময় আমি বিপুল বিক্রম সঞ্চয় করতাম, ছড়ি ঘোরাতাম শব্দদের উপর, তাদের বশ করে আমি সমর্পণ করতাম তোমার পূজোয়। তুমি চলে যাওয়ার পর তার আর দরকার পড়েনি কোনদিন।

তবে বেশ টের পেতাম, আস্তে আস্তে শব্দরা বড় হচ্ছে আমার চোখের আবডালে, শ্বাসগুলো হয়ে উঠছে দীর্ঘশ্বাস- যেভাবে ইউক্যালিপটাস বেড়ে ওঠে প্রতিদিন, আমিও প্রৌঢ় হচ্ছি শব্দদের সেই সংসারে- তিন-মাথা বুড়োর মতো।

তারপর সেদিন সন্ধ্যায় তোমার সাথে কথা হওয়ার পর, তোমার কাছ থেকে গল্প লেখার আবদার পেয়ে পুরোনো নেশাটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠল ফের।

আমার ফ্ল্যাটের যে ঘরটাতে টুকটাক অফিসের কাজ করতাম এতদিন, সেই ঘরটাকে বানালাম পড়া আর লেখার ঘর। আমার ছোট্ট ছেলে-মেয়ে দু’টোর প্রবেশ নিষিদ্ধ করলাম সেখানে। দ্য ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেস এর বদলে বাসায় রাখা ধরলাম তোমার দৈনিকটি।

স্ত্রীকে বললাম সে যেন গৃহ-পরিচারিকাকে বলে দেয় ভুলেও এ ঘর থেকে দুমড়ানো-মুচড়ানো কোন পৃষ্ঠা, বা হালকা-দৃষ্টিতে অদরকারী মনে হওয়া কোন কাগজ যেন ফেলে না দেয় কখনো। লিখতে হলে পড়তে হবে আগে। তাই এর মধ্যে একদিন অফিস ফাঁকি দিয়ে ছুটলাম শাহবাগে।

আজিজ সুপার মার্কেটে ঘণ্টাদু’য়েক ঘুরে ঘুরে কিনে আনলাম একগাদা বই- তার কোনটা সৈয়দ শামসুল হক’র, আবার কোনটা হাসান আজিজুল হক, সন্দীপন চট্টোপাধ্যয়, কায়েস আহমেদ, মামুন হুসাইন, রায়হান রাইন কিংবা অদিতি ফাল্গুনীদের। দৈনন্দিন কর্মযজ্ঞেও এলো কিছুটা পরিবর্তন।

অফিস শেষ করে এখন আমি রোজ চলে আসি সোজা বাসায়, এসেই বইয়ের মধ্যে মুখ গুঁজে পড়ে থাকি। মাসখানেক যাওয়ার পরে ভিতর থেকে তাড়না এলো বলে এক ঘোরলাগা সন্ধ্যায় আবার কলম ধরলাম হাতে, আমার দামী পার্কার কলমটা।

টেনে নিলাম চকচকে ডায়রিটা, প্রতিবারের মতো এবারও বছরের শুরুতে একটা ব্যাংক আমাকে দিয়েছে ওটা উপহার হিসাবে।

একটু চেষ্টা করতেই টের পেলাম, এই এগারো বছরে শব্দরা বেশ ডাগর হয়ে উঠেছে, কিছুতেই চায় না তারা তিন-মাথা বুড়োর বশ্যতা স্বীকার করতে। ঘণ্টাদুয়েক চেষ্টার পর সেদিনের মতো ক্ষান্ত দিয়ে সরিয়ে রাখলাম লেখার খাতা।

এরপর প্রতিদিন চলতে লাগল…

Comments to: হারিয়ে যাওয়া প্রেমিকার কাছে চিঠি

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    Attach images - Only PNG, JPG, JPEG and GIF are supported.

    Login

    Welcome to Chithipotro

    You are couple of steps away from being one of our family member
    Join Us