প্রিয়তমা মানসী আমার!
আজ আমার বিদায় নেবার দিন! একে একে সকলেরই কাছে বিদায় নিয়েছি। তুমিই বাকি! ইচ্ছা ছিল, যাবার দিনে তোমায় আর ব্যথা দিয়ে যাব না, কিন্তু আমার যে এখনো কিছুই বলা হয়নি। তাই ব্যথা পাবে জেনেও নিজের এই উচ্ছৃঙ্খল বৃত্তিটাকে কিছুতেই দমন করতে পারলুম না। তাতে কিন্তু আমার দোষ দিতে পারবে না, কেননা তোমার মনে তো চিরদিন গভীর বিশ্বাস যে, আমার মতন এত বড় স্বার্থপর হিংসুটে দুনিয়ায় আর দুটি নেই। আমার কথা তোমার কাছে কোনোদিনই ভালো লাগেনি (কেন তা পরে বলছি) আজও লাগবে না তবু লক্ষ্মী, এই মনে করে চিঠিটা একটু পড়ে দেখো যে, এটা একটা হতভাগা লক্ষ্মীছাড়া পথিকের অস্ত-পারের পথহারা পথে চিরতরে হারিয়ে যাওয়ার বিদায় কান্না। আজ আমি বড় নিষ্ঠুর, বড় নির্মম।
আমার কথাগুলো তোমার বে-দাগ বুকে না-জানি কত দাগই কেটে দেবে! কিন্তু বড় বেদনায়, প্রিয়, বড় বেদনায় আজ আমায় এত বড় বিদ্রোহী, এত বড় স্বেচ্ছাচারী উন্মাদ করে তুলেছে। তাই আজও এসেছি কাঁদাতে। তুমিও বলো, আমি আজ জল্লাদ, আমি আজ হত্যাকারী কশাই। শুনে একটু সুখী হই। আমার মন বড় বিক্ষিপ্ত। তাই কোনো কথাই হয়তো গুছিয়ে বলতে পারব না। যার সারা জীবনটাই ব’য়ে গেলে বিশৃঙ্খল আর অনিয়মের পূজা করে, তার লেখায় শৃঙ্খল বা বাঁধন খুঁজতে যেও না। হয়তো যেটা আরম্ভ করবো সেইটেই শেষের, আর যেটায় শেষ করবো সেইটেই আরম্ভের কথা! আসল কথা, অন্যে বুঝুক চাই নাই বুঝুক, তুমি বুঝলেই হল। আমার বুকেই এই অসম্পূর্ণ না-কওয়া কথা আর ব্যথা তোমার বুকের কথা আর ব্যথা দিয়ে পূর্ণ করে ভরে নিও।
এখন শোনো। প্রথমেই আমার মনে পড়ছে (আজ বোধ হয় তোমার তা মনেই পড়বে না), তুমি যেন এক দিন সাঁঝে আমায় জিজ্ঞেস করেছিলে, কি করলে তুমি ভালো হবে? তোমারই মুখে আমার রোগ-শিয়রে এই নিষ্ঠুর প্রশ্ন শুনে অধীর অভিমানের গুরু বেদনায় আমার বুকের তলা যেন তোলপাড় করে উঠল!হায়, আমার অসহায় অভিমান! হায়, আমার লাঞ্ছিত অনাদৃত ভালোবাসা। আমি তোমার সে প্রশ্নের উত্তর দিতে পারিনি। দেয়া উচিতও হত না! তখন আমার হিয়ার বেদনা-মন্দিরে যেন লক্ষ তরুণ সন্ন্যাসীর ব্যথা জীবনের আর্ত হাহাকার আর বঞ্চিত যৌবনের সঞ্চিত ব্যথা-নিবেদনের গভীর আরতি হ’চ্ছিল। যার জন্যে আমার এত ব্যথা, সেই এসে কিনা জিজ্ঞেস করে, তোমার বেদনা ভালো হবে কিসে?… মনে হল, তুমি আমায় উপহাস আর অপমান করতেই অমন করে ব্যথা দিয়ে কথা কয়ে গেলে। তাই আমার বুকের ব্যথাটা তখন দশগুণ হয়ে দেখা দিল। আমি পাশের বালিশটা বুকে জড়িয়ে নিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লুম। আমার সবচেয়ে বেশি লজ্জা হতে লাগল, পাছে তুমি আমার অবাধ্য চোখের জল দেখে ফেল! পাছে তুমি জেনে ফেল যে আমার বুকের ব্যথাটা আবার বেড়ে উঠেছে! যে আমার প্রাণের দরদ বোঝে না, সেই বে-দরদীর কাছে চোখের জল ফেল আর ব্যথায় এমন অভিভূত হয়ে পড়ার মতো দুর্নিবার লজ্জা আর অপমানের কথা আর কী থাকতে পারে? কথাও কইতে পারছিলুম না, ভয় হচ্ছিল এখনই আর্দ্র গলার স্বরে তুমি আমার কান্না ধরে ফেলবে! যাক, ভগবান আমায় রক্ষা করলেন সে বিপদ থেকে। তুমি অনেক্ষণ দাঁড়িয়ে কি যেন ভাবতে লাগলে। তারপর আস্তে আস্তে চলে গেলে।
তুমি বোধহয় আজ পড়ে হাসবে, যদি বলি যে আমার তখন মনে হল, যেন তুমি যাবার বেলায় ছোট্ট একটি শ্বাস ফেলে গিয়েছিলে। হায় রে অন্ধ বধির ভিখারী মন আমার! যদি তাই হত, তবে অন্তত কেন আমি অমন করে শুয়ে পড়লুম, তা একটু মুখের কথায় শুধাতেও তো পারতে! তুমি চলে যাবার পরেই ব্যথার অভিমানে আমার বুক যেন একেবারে ভেঙে পড়ল। নিষ্ফল আক্রোশে আর ব্যর্থ বেদনার জ্বালায় আমি হুঁকরে হুঁকরে কাঁদতে লাগলুম। তখন সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। তারপর ডাক্তার এল, আত্মীয়-স্বজন এল, বন্ধু-বান্ধব এল। সবাই বললে,- হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বড় অস্বাভাবিক। গতিক… ডাক্তার বললে,-রোগী হঠাৎ কোনোÑ ইয়েÑ কোনো বিশেষ কারণে এমন অভিভূত হয়ে পড়েছে। এ কিন্তু বড্ডো খারাপ। এতে এমনও হতে পারে যে…।
বাকিটুকু ডাক্তার আমতা আমতা করে না বললেও আমি সেটার পূরণ করে দিলুম- একেবারে নির্বাণ দীপ গৃহ অন্ধকার! না ডাক্তার বাবু? বলেই হাসতে গিয়ে কিন্তু এত কান্না পেল আমার যে, তা অনেকেরই চোখ এড়াল না। সত্যিই তখন আমার কণ্ঠ বড় কেঁপে উঠেছিল, অধর কুঞ্চিত হয়ে উঠেছিল, চোখের পাতা সিক্ত হয়ে উঠেছিল। আমি আবার উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লুম। অনেক সাধ্য-সাধনা করেও কেউ আর আমায় তুলতে পারলে না। আমার গোঁয়ার্ত্তুমির অনেকক্ষণ ধরে নিন্দে করে বন্ধু-বান্ধবরা বিদায় নিলে।
আমিও মনে মনে খোদাকে ধন্যবাদ দিলুম।

Comments to: প্রথম স্ত্রী নার্গিসকে লেখা কবি নজরুলের ঐতিহাসিক চিঠি

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    Attach images - Only PNG, JPG, JPEG and GIF are supported.

    Login

    Welcome to Chithipotro

    You are couple of steps away from being one of our family member
    Join Us