আমার মা আমাকে একবার কানে কানে একটা কথা বলেছিল। ফিসফিস করে বলেছিল, যাতে কেউ শুনতে না পায়। আমার কানটাকে টেনে কাছে এনে মা বলেছিল, ‘কাউকে বলবি না তো?’ আমি বললাম, ‘কী?’

‘আগে বল বলবি না।’

আমি বললাম, ‘না বলব না।’ মা বলল, ‘দুর্গার ক’টা হাত?’

আমি বললাম, ‘দশটা।’ মা বলল, ‘কোনও দিন দুর্গার দশটা হাত ছিল না। প্রথম দিন দুটো ছিল, তার পর তিনটে হল তার পর চারটে হল, এ ভাবে কি একটার পর একটা হাত গজায় কারও? তুই দুটো হাত নিয়ে পৃথিবীতে এসেছিস, তোর কি কোনও দিন চারটে হাত হবে? দুর্গার হাত প্রথমে দুটো ছিল, আজও দুটো আছে। একশো বছর পরেও দুটো থাকবে।’

মা যে দিন কথাটা ফিসফিসিয়ে বলেছিল, সেই ফিসফিসানোর বয়স একশো বছর না হলেও, পঞ্চাশ হল। মাকে কথা দিয়েছিলাম, কাউকে বলব না, বলিনি। আজ লিখলাম। আমার মা পাবনা থেকে পালিয়ে আসা একটি মেয়ে, যে কি না সীমান্ত পেরোনোর সময় বাবার সঙ্গে বমাল ধরা পড়ে ত ত করে জিজ্ঞাসা করেছিল রাইফেলধারীকে- তোমরা এপারে তুলসি লাগাতে দেবে তো?

সেটা ছিল কোজাগরীর আগে। দীপাবলিতে কোনও দ্বীপ জ্বলেনি সে বার। আমার মা স্কুল কলেজে যায়নি কোনও দিন। কিন্তু গীতার এক একটি অধ্যায় রোজ পুকুরে ডুব দিয়ে উঠে ভিজে কাপড়ে বলতে বলতে তুলসিগাছে জল দিত। পঞ্চাশ বছর আগে মায়ের কথাটা হুবহু মনে পড়ছে আজ, দুর্গার দশহাত ছিল না কখনও। আজও নেই। ফিসফিস করে নয়, এসপ্ল্যানেডে দাঁড়িয়ে মাইকে মাইকে বলতে ইচ্ছে করছে মায়ের কথাটা, দুর্গার দুটো হাত। তাকিয়ে দেখুন, দুটো হাত দিয়ে যে কাজ দুর্গা করেছিলেন, সেটা দশহাত থাকলেও অনেকে পারবে না। এখানেই ‘মেটাফর’-এর জয়, রূপকের উদ্যাপন। যে মানুষটি কল্পনা করেছিল দশহাতের, তিনি একজন বড় মাপের কবি। বাল্মীকির সমান।

আমাদের পাড়ায় থাকতেন শিউলিদি। বউ হয়ে এসেছিলেন। কিন্তু সে বাড়িতে কোনও রোজগার নেই। বর পঙ্গু। পাড়ায় একটা চা বিস্কুটের দোকান দিলেন। সেই টাকায় বাজার করতেন, ছেলেকে পড়াতেন। মারতে মারতে স্কুলে নিয়ে যেতেন। বরের ওষুধ কিনে আনতেন। শাশুড়িকে স্নান করাতেন। দোকান বড় হল। এক ঘরের বাড়ি বানালেন। বর মারা গেল। ছেলে হায়ার সেকেন্ডারিতে স্টার পেল। ছেলেকে ডাক্তারি পড়ালেন। ছেলে এখন কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসক।

এই শিউলিদির যদি দশ হাত না থাকে, তো কার দশ হাত আছে? এই শিউলিদিকে যদি আমি দুর্গা বলতে না পারি, তা হলে মাটির দুর্গাকে সারাজীবন প্রণাম করে কী হবে? আমার কাছে শিউলি মানে শরৎ নয়, আমার কাছে শিউলি মানে চা বিস্কুটের দোকান চালানো শিউলিদি। যে মেয়েটি কাঁখে ছেলে নিয়ে মাথায় আটটা ইট নিয়ে প্রোমোটারের বাড়ি বানাচ্ছে সে কি দুর্গা নয়? যে মেয়েটি গ্রাম থেকে উড়ে গেল সেদিন ওয়াশিংটন ডিসি, নাসায় বিজ্ঞানী হিসেবে যোগ দিতে, সে যখন দু’দিন বাদে গ্রামের বাড়িতে ফিরবে ছুটি নিয়ে, তাকে দেখার জন্য বেশি ভিড় হবে, সে কি দুর্গা নয় বলে? নাকি দুর্গা বলে? কল্পনা চাওলা যখন মহাকাশ থেকে ছাই হয়ে ঝরে পড়েছিল, তখন কি মনে হয়নি, আহা রে একটা দুর্গা ছাই হয়ে গেল! তার পর দেখলাম, সেই ছাই থেকে আরও নতুন দুর্গা বেরিয়ে এল। তাদের কারও দশটা হাত নেই। সবার দু’টো করে হাত।

দুর্গাপুজো আসলে সবার পুজো। বড়লোকের পুজো, মধ্যবিত্তের পুজো, প্রান্তিকের পুজো, ব্রাহ্মণের পুজো, কোল ভিল সাঁওতালের পুজো। যদিও বহু সাঁওতালের বাড়ি পাঁচদিন কালো কাপড়ে ঘিরে রাখা হয়। শোকের চিহ্ন হিসেবে, সে এক অন্য গল্প। অসুর তাঁদের প্রতীক। অনার্য জনজাতির দেবতা। তাঁরা বিশ্বাস করেন, এই পুজোর ভিতরে লুকিয়ে রয়েছে আর্য সাম্রাজ্যবাদ। অসুরকে শূল বিদ্ধ করে পুজো করাটা তাঁরা অনেকেই ভালো চোখে নেন না। তাই শোক। তাই কালো কাপড়।

যে কোনও উৎসবের পিছনেই থাকে একটা না একটা পরাজয়ের কাহিনি। বশ্যতার কাহিনি। ক্ষমতা দেখানোর উল্লাস। কিন্তু দুর্গা আমার চোখে হাজার হাজার লক্ষ কোটি মেয়ের উঠে দাঁড়ানোর গল্প। প্রতিটি মেয়ের মধ্যে একটি লুকোনো দুর্গা আছে। প্রতিটি মেয়ের মধ্যে আটটা লুকোনো হাত রয়েছে। একটা একটা করে সেই হাত বের করে নিয়ে আসার নাম দুর্গাপুজো। আর সেই পুজোর গন্ধের নাম শিউলি।

Comments to: দুর্গার জন্য লেখা

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    Attach images - Only PNG, JPG, JPEG and GIF are supported.

    Login

    Welcome to Chithipotro

    You are couple of steps away from being one of our family member
    Join Us