স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিগণ জীবনের নানাবিধ প্রয়োজনে সম্পত্তি হস্তান্তর, ক্রয়-বিক্রয়, বিভিন্ন ধরনের চুক্তিপত্র ও বন্ধকী দলিল সহ নানাবিধ দলিল সংশ্লিষ্ট সাব-রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ে সম্পাদন ও রেজিস্ট্রি করে থাকেন।
পক্ষগণের প্রতারণামূলক ও পারস্পরিক ভুলের কারণে দলিলের দাগ নম্বর, খতিয়ান নম্বর, মৌজার নাম, সীমানা চৌহদ্দিতে বা নামের ছোট-খাটো ভুল সহ দলিল সম্পাদন ও রেজিস্ট্রি হয়ে যায়।
পরবর্তীতে সেই সমস্ত ভুল দৃষ্টিগোচর হয় বা ধরা পড়ে। এক্ষেত্রে স্বার্থ সংশ্লিষ্ট পক্ষগণ দুশ্চিন্তায় পড়ে যান। এই ধরনের ছোট-খাটো ভুলের কারণে দলিল বাতিল হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই বরং যত দ্রুত সম্ভব সংশ্লিষ্ট পক্ষগণ উক্ত ভুল সংশোধনের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করবেন।
এক্ষেত্রে পক্ষগণের পারস্পারিক সমঝোতা ও সম্মতির মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট সাব-রেজিস্ট্রারের মাধ্যমে উক্ত ভুল সংশোধনের জন্য ভ্রম-সংশোধন বা ঘোষণাপত্র দলিল সম্পাদন ও রেজিস্ট্রি করা যায়।
এই ধরনের ভ্রম-সংশোধন দলিল বা ঘোষণাপত্র দলিল মালিকানার মূল দলিল হিসেবে গণ্য হবে না বরং পূর্বের দলিলের অংশ বলিয়া গণ্য হবে।
অনেক ক্ষেত্রে স্বার্থ সংশ্লিষ্ট পক্ষগণের মৃত্যুতে অথবা সমঝোতার মাধ্যমে সম্মতিতে সংশ্লিষ্ট সাব-রেজিস্টার এর মাধ্যমে দলিল সংশোধন করা না গেলে সিভিল কোর্ট বা দেওয়ানী আদালতের মাধ্যমে দলিল সংশোধনের জন্য মামলা দায়ের করা যায়।
সাব-রেজিস্ট্রারের মাধ্যমে দলিল সংশোধন
সংশ্লিষ্ট সাব-রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ে দলিল রেজিস্ট্রির পর তাতে দাগ নম্বর, খতিয়ান নম্বর, মৌজার নাম, সীমানা চৌহদ্দিতে বা নামের ছোট-খাটো কোন ভুল ধরা পড়লে এবং যে ভুল সংশোধন করলে দলিলের মূল কাঠামো, প্রয়োজনীয় শর্তাদি বা স্বত্বের কোন পরিবর্তন ঘটবে না সেরূপ ভুল সংশোধনের জন্য সংশ্লিষ্ট সাব-রেজিস্ট্রার বরাবরে আবেদন করা যাবে।
সাব-রেজিস্ট্রার এই ধরনের ছোট-খাটো ভুল ভ্রম-সংশোধন বা ঘোষণাপত্র দলিল এর মাধ্যমে সংশোধন করতে পারেন।
আরো পড়ুন
- দলিলের ভুল সংশোধন
- জমির খতিয়ান কি ও কত প্রকার
- অনলাইনে জমির দলিল বের করার নিয়ম
- জমির পরিমাপ পদ্ধতি
- বায়নানামা দলিল লেখার নিয়ম
- জমির হিসাব বের করবেন যেভাবে
- জমির মাপ
- বায়না দলিল বাতিল করার নিয়ম
- কোন চুক্তিপত্রে কত টাকার স্টাম্প ব্যবহার করতে হয়
- দলিল বাতিলের মামলা কিভাবে করতে হয়, কি কি লাগে?
আদালতের মাধ্যমে মামলা দায়ের করে ভুল সংশোধন
১৮৭৭ সালের সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৩১ ধারায় বলা হয়েছে, যেক্ষেত্রে প্রতারণা অথবা পক্ষগণের পারস্পরিক ভুলের জন্য কোন লিখিত দলিল হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে দলিলের যে কোন পক্ষ অথবা তাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধি দলিলটি সংশোধনের জন্য মামলা দায়ের করতে পারেন।
দলিল সংশোধনের মামলায় প্রতারণা বা পারস্পরিক ভুল অবশ্যই থাকতে হবে। তা না হলে দলিল সংশোধনের মামলা দায়ের করা যাবে না। প্রতারণা বা পারস্পরিক ভুল আদালতের কাছে অবশ্যই প্রমাণিত হতে হবে। উভয় পক্ষের সাধারণ ভুল থাকতে হবে, যে কোনো এক পক্ষের ভুল থাকলে চলবে না।
মামলা দায়ের করার জন্য তামাদির মেয়াদ
প্রতারণা বা পারস্পরিক ভুল সম্পর্কে অবগত হওয়ার পর অহেতুক বিলম্ব না করে ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষের উচিত দলিল সংশোধনের জন্য যত দ্রুত সম্ভব সিভিল কোর্ট বা দেওয়ানী আদালতে মামলা দায়ের করা।
দলিল রেজিস্ট্রির পর তাতে দাগ নম্বর, খতিয়ান নম্বর, মৌজা, সীমানা চৌহদ্দি বা নামের ছোটখাটো ধরনের কোন প্রতারণা বা পারস্পরিক ভুল সম্পর্কে অবগত হওয়ার পর তা সংশোধনের জন্য ১৮৭৭ সালের সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৩১ ধারা অনুসারে তিন বছরের মধ্যে সিভিল কোর্ট বা দেওয়ানী আদালতে মামলা দায়ের করতে হবে।
তিন বছর পর এরূপ মামলা তামাদির দ্বারা বারিত হয়ে যায়। তাই তখন আর সংশোধন মামলা দায়ের করা যায় না, তবে ঘোষণা মূলক মামলা দায়ের করা যায়। এরূপ মামলার রায়ই হল সংশোধন দলিল।
রায়ের ১ কপি আদালত হতে সংশ্লিষ্ট সাব-রেজিস্ট্রার এর কার্যালয়ে পাঠানো হলে সাব-রেজিস্ট্রার উক্ত রায়ের আলোকে সংশ্লিষ্ট ভলিউম সংশোধন করে নিবেন, ফলে নতুন করে কোন দলিল করার আর কোন প্রয়োজন হবে না।
Whiteside Vs. Whiteside (1950) Ch 65-মামলায় দলিল সংশোধনের ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো বিবেচনার কথা বলা হয়েছে:
১। দলিলটি ভুলক্রমে লিখিত হয়েছে কিনা।
২। দলিলের একপক্ষ অপরপক্ষের প্রতি প্রতারণা করেছেন কিনা।
৩। দলিল সংশোধনের বিরুদ্ধে কোন সুস্পষ্ট সাক্ষ্য আছে কিনা।
৪। দলিল সংশোধনের মামলায় বিকল্প প্রতিকারমূলক ব্যবস্থার কথা উল্লেখ আছে কিনা।
মূলত যে সকল কারণে দলিল সংশোধন করা যায়
১। পক্ষগণের প্রতারণার ফলে যদি দলিলে ভুল হয়।
২। পক্ষগণের পারস্পরিক ভুলের জন্য যদি দলিল ভুলভাবে লিখিত হয়।
৩। পক্ষগণের প্রকৃত মনোভাব যদি দলিলে ভুলভাবে লিখিত হয়।
৪। পক্ষগণের প্রতারণা বা ভুল যদি আদালত দলিল কার্যকর করার সময় নির্ণয় করতে পারেন।
৫। কোন চুক্তিপত্রের সাথে যদি পক্ষগণের ইচ্ছা পরস্পর বিরুদ্ধ হয়ে দাঁড়ায় তাহলে চুক্তিপত্রটি আদালত সংশোধন করতে পারবেন।
নিম্নলিখিত ব্যক্তিগণ দলিল সংশোধনের মামলা দায়ের করতে পারেন
১। দলিলের যেকোন পক্ষ।
২। দলিলের যেকোন পক্ষের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধিগণ।
৩। দলিলের যেকোন পক্ষের স্থলবর্তী পরবর্তী উত্তরাধিকারীগণ।
৪। দলিলের যেকোন পক্ষের নিকট হতে হস্তান্তর গ্রহীতাগণ।
৫। দলিলের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিগণ।
রেজিস্ট্রি দলিল অর্থাৎ সাফ কবলা দলিল, লিখিত চুক্তিপত্র, বন্ধকী দলিল ১৮৭৭ সালের সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৩১ ধারা অনুসারে সংশোধন করা যায়। দলিল সংশোধনের মামলা করলেই যে আদালত দলিল সংশোধনের আদেশ দিবেন এমন নয়।
আদালত তার বিবেচনামূলক ক্ষমতা (Discretionary Power) প্রয়োগ করে দলিল সংশোধনের আদেশ দিবেন। মোকদ্দমার কোন পক্ষ অধিকারবলে (as of right) দলিল সংশোধন চাইতে পারে না। এটা সম্পূর্ণ আদালতের ইচ্ছাধীন ক্ষমতা।
দলিল সংশোধনের মামলায় আদালত দলিল সংশোধনের আদেশ দিতেও পারেন, আবার নাও দিতে পারেন। সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ২২ ধারা অনুসারে আদালতের স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা সুষম, যুক্তিযুক্ত এবং বিচার কার্যাবলীর মূলনীতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে হবে। আদালতের বিবেচনামূলক ক্ষমতা কোন ক্রমেই স্বেচ্ছাচারী হবে না।
সিভিল আদালতের অধিকাংশ মামলা ১৮৭৭ সালের সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইন অনুসারে পরিচালিত হয়। সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের বিষয়বস্তু ইকুইটি থেকে গ্রহণ করা হয়েছে।
১৮৭৭ সালের সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইন প্রণয়নের সময় সুনির্দিষ্ট প্রতিকার সংক্রান্ত ইকুইটির বিষয়গুলি ভারতীয় উপমহাদেশের প্রেক্ষাপট তুলে ধরা হয়েছে। যা সিভিল আইনের মূল বিষয়।
সিভিল আদালতের অধিকাংশ মামলা এই সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইন অনুসারে পরিচালিত হয়। এই আইনের আলোকে স্বত্বের মামলা, দখল উদ্ধারের মামলা, চুক্তির সুনির্দিষ্ট কার্য সম্পাদনের মামলা, দলিল সংশোধনের মামলা, চুক্তি বাতিলের মামলা, দলিল বাতিলের মামলা, ঘোষণামূলক মামলা, নিষেধাজ্ঞা মামলা ইত্যাদি।
যে সকল দলিল সংশোধনের জন্য মামলা দায়ের করা যায়
১। বিক্রয় দলিল বা সাফ কবলা দলিল ১৮৭৭ সালের সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৩১ ধারা অনুসারে সংশোধন করা যায়।
২। লিখিত চুক্তিপত্র ৩১ ধারা অনুসারে সংশোধন করা যায়।
৩। বন্ধকী দলিল সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৩১ ধারা অনুসারে সংশোধন করা যায়। বন্ধকী দলিলের পক্ষগণ বন্ধকী সম্পত্তির বর্ণনা প্রদান করতে পারস্পরিক ভুল করলে ৩১ ধারা অনুসারে দলিল সংশোধনের মামলা দায়ের করা যায়।
সাধারনত সোলে ডিক্রী সংশোধন করা যায় না। মোকদ্দমার দুই পক্ষের সম্মতির ভিত্তিতে আদালতের দেয়া ডিক্রিকে সোলে ডিক্রি বলে। আপোস-নিষ্পত্তির আবেদনে ভুল থাকলে এবং এই ভুলের ভিত্তিতে আদালতের ডিক্রি পেলে পরবর্তীতে এই উদ্দেশ্য মামলা দায়ের করে দলিল সংশোধন করা যায়।
যে সকল ক্ষেত্রে দলিল সংশোধনের মামলা করা যায় না
১। যখন তৃতীয় ব্যক্তি যথাযথ মূল্যের বিনিময়ে সরল বিশ্বাসে জমি ক্রয় করেন তখন তার অধিকার হস্তক্ষেপ করে দলিল সংশোধন করা যায় না।
২। পক্ষগণের পারস্পরিক ভুল না হয়ে যদি একপক্ষের ভুল হয় তাহলেও দলিল সংশোধন করা যাবে না।
৩। আইনগত ভুলের কারণে দলিলে ভুল হলে সেই দলিল সংশোধন করা যাবে না।
৪। বাদী ইচ্ছাকৃতভাবে কোন শর্ত সংযোজন বা বিয়োজন করলে আদালত কখনো দলিল সংশোধনের ডিক্রী প্রদান করবেন না।
দলিল সংশোধনের মামলা দায়ের না করে দলিল সংশোধনের বিকল্প প্রতিকার
১। অন্য কোন ব্যক্তি দখল উদ্ধারের মামলা দায়ের করলে সেই মামলার আত্নরক্ষায় দলিল সংশোধনের দাবী উপস্থাপন করা যায়।
২। রিডেমশনের মামলায় দলিল সংশোধনের প্রশ্ন উত্থাপন করা যায়।
৩। দলিল সংশোধনের মামলা দায়ের না করে সম্পত্তি পুনরুদ্ধারের মামলা করা যায়।
৪। দখল স্হায়ীকরণের ডিক্রী লাভের জন্য মামলা দায়ের করা যায়।
৫। দলিল সংশোধনের মামলা তামাদিতে বারিত হওয়ার পর স্বত্ব ঘোষণার মামলা দায়ের করা হলে তা গ্রহণযোগ্য হবে।[36 DLR 337]
মামলা প্রমাণের দায়িত্ব কে বহন করবেন?
১৮৭৭ সালের সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৩১ ধারা অনুসারে দলিল সংশোধনের মামলায় প্রতারণা বা পারস্পরিক ভুল প্রমাণের দায়িত্ব সেই পক্ষের, যে পক্ষ দলিল সংশোধনের প্রার্থনা করে।
যে ব্যক্তি দলিল সংশোধন দাবী করে তার উপর প্রমাণের ভার কঠোরভাবে অর্পিত হয়। এক্ষেত্রে দলিলে ভুলের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষই প্রতিকার চেয়ে আদালতে মামলা দায়ের করেন।
No Comments
Leave a comment Cancel