প্রিয় রুদ্র,
প্রযত্নে, আকাশ

তুমি আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখতে বলেছিলে। তুমি কি এখন আকাশ জুড়ে থাকো? তুমি কি আকাশে উড়ে বেড়াও তুলোর মত? পাখির মত? আমারও খুব পাখি হতে ইচ্ছে করে।

আমারও সারা আকাশ উড়ে উড়ে মেঘের সঙ্গে খেলতে ইচ্ছে করে। ছোটবেলায় ছাদে উঠে আকাশ দেখতাম খুব। রাতে তারা গুণতাম। সবাই আমাকে পাগল বলত, বলত পাগল ছাড়া আর কেউ তারা গোণে না।

আমি যে কেন রাতভর তারা গুণতাম, বুঝি না। মাঝে মাঝে এত ঘোরের মধ্যে থাকতাম যে আকাশের দিকে হাত বাড়িয়ে দিতাম, যেন নাগাল পাওয়া যাবে, যেন আমি স্পর্শ করলেই নক্ষত্রগুলো ফুলের পাপড়ির মত আমার হাতে ঝরে পড়বে।

এখনও ফাঁক পেলেই আকাশ দেখি। জানালার কাছে বিছানা পেতেছি। লেখার টেবিলটি এমন জায়গায় রেখেছি যেন আকাশ দেখা যায়। বাড়িতে গাছপালার ডাল ছড়ালে ছেঁটে দিই যেন আকাশ আবার ঢেকে না যায়।

তুমি এই জগৎ সংসার ছেড়ে আকাশে চলে গেছ, তুমি আসলে বেঁচেই গেছ রুদ্র। আমরা যারা জলে ডাঙায় পড়ে আছি, তাদের যন্ত্রণা কিন্তু কম নয়। বেঁচে থেকে তুমিও তো যন্ত্রণা কম পোহাওনি।

আচ্ছা, তোমার কি এরকম ইচ্ছে হয় না আবার একদিন পাখি হয়ে উড়ে উড়ে ফিরে আসতে, যেখানে ছিলে সেখানে, সেই ইন্দিরা রোডের বাড়িতে, আবার সেই নীলক্ষেত, শাহবাগ, পরীবাগ, লালবাগ চষে বেড়াতে?

ইচ্ছে তোমার হয় না – এ আমি বিশ্বাস করি না। ইচ্ছে ঠিকই হয়। পারো না। অথচ একসময় যা ইচ্ছে হত তোমার, তাই করতে। ইচ্ছে যদি হত সারারাত না ঘুমিয়ে গল্প করতে, করতে।

ইচ্ছে যদি হত সারাদিন পথে পথে হাঁটতে, হাঁটতে। ইচ্ছে যদি হত মেথরপট্টি গিয়ে পেট ভরে মদ খেতে, খেতে। কে তোমাকে বাঁধা দিত !

ঠিক এইরকম অনুভব একসময় আমার জন্য ছিলো তোমার ! আজ আরেকজনের জন্য তোমার অস্থিরতা। নির্ঘুম রাত কাটাবার গল্প শুনে আমার কান্না পায় না বলো? তুমি শিমুলকে নিয়ে কি কি কবিতা লিখলে তা দিব্যি বলে গেলে !

জীবন তোমার হাতের মুঠোয় ছিল, এই জীবন নিয়ে যেমন ইচ্ছে খেলেছ। আমার ভেবে অবাক লাগে জীবন এখন তোমার হাতের মুঠোয় নেই।

যারা তোমাকে একদিন ট্রাকে উঠিয়ে মিঠেখালি নিয়ে গেল মাটির তলায় পুঁতে রাখতে, তুমি তাদের বলতে পারোনি না যাব না। ঘুরে দাঁড়াতে পারোনি।

মিঠেখালির সেই কবরখানার কথা বড় মনে পড়ে, একদিন তুমি বলেছিলে – এখানে আমার বড় মামা আছেন, সেজ মামাও, আমার নানু, নানা।

কে জানত, এরপর তোমার চেয়ে দ্বিগুণ বয়সী তোমার মামা মামি মা খালাদের রেখে তুমি ওই কবরখানায় ঢুকবে !

আরো পড়ুন তসলিমা নাসরিনকে বিয়ে করার পর বাবার কাছে রুদ্রের চিঠি

আচ্ছা রুদ্র, তোমার শরীরখানাকে যখন মাটিচাপা দিল তখন কষ্ট হয়নি তোমার? মাঝে মধ্যে আমি মাটি চাপা কষ্ট অনুভব করি, মনে হয় আশেপাশের মানুষগুলো আমাকে আস্ত পুঁতে ফেলছে মাটিতে, আমার চোখে আলো পড়ছে না।

আমি কথা বলতে পারছি না। শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। মৃত্যুর আগেই এমন মৃত্যুযন্ত্রণা অনুভব আর কি কেউ করে? এদিক থেকে আমার বোধহয় লাভই হল, আমি যখন মরব, আমার কষ্ট অনেকটা কমে আসবে।

বলতে পারো আমি কিভাবে মরব? আমি ঠিক জানি ওরা আমাকে মেরে ফেলবে একদিন, যেকোনও দিন দেখব মরে পড়ে আছি। হাত পায়ের রগ কাটা। আমাকে তুমি বলেছিলে – ‘আমার মরতে ইচ্ছে করে মিছিলে, গুলি খেয়ে।’

তসলিমা নাসরীন

মৃত্যুর কথা শুনে আমার গা কাঁপত। জগতে মৃত্যুর মত ভয়ংকর আর কিছু নেই। মৃত্যু আছে জেনেও আমি বুঝি না মানুষ কি করে দীর্ঘস্থায়ী করে মানুষের প্রতি মানুষের বিদ্বেষ, বিচ্ছেদ!

ভাবলে আমার অবাক লাগে এই পৃথিবীতে আমি আর থাকব না। আমিও তোমার মত হুট করে একদিন মরে যাব। তোমার মত দাঁত মাজতে মাজতে চমৎকার একটি দিন শুরু করব যখন, দেখব মুখ থুবড়ে পড়ে আছি বেসিনে।

আচ্ছা, এরকম হতে পারে না প্রতি একশ বছর পর পর জন্ম নেব! তাতে একটি লাভ হবে, মানুষ কত সভ্য হল তা চোখে দেখতে পাব।

এখন তো আমার প্রায়ই মনে হয় এদেশের মানুষ দিন দিন এমন অধঃপাতে যাচ্ছে, তাদের আর সভ্য হবার সম্ভাবনা নেই।

আবার এও মনে হয় দেশ থেকে একদিন মৌলবাদ দূর হবে, ধর্ম দূর হবে, মানুষ সুস্থসুন্দর জীবন যাপন করবে, এরকম দিন নিশ্চয় একদিন আসবে, একবার দুচোখ মেলে সেই দিনটি আমার দেখতে ইচ্ছে করে।

তুমি ধর্ম মানতে না, অথচ দেখ তোমার মৃত্যু উপলক্ষ্যে কোরানখানি মিলাদ মাহফিল কী না হল! তোমার যদি বাধা দেবার শক্তি থাকত, আমি জানি দিতে।

মনে আছে তুমি আমি দুজন মিলে সন্ধানীতে চোখ দিয়েছিলাম, শরীর দিয়েছিলাম, যেন মৃত্যুর পর চোখ কোনও অন্ধকে আলো দেয়, যেন মেডিকেল কলেজের শব-ব্যবচ্ছেদ কক্ষে শরীর কেটে ছিঁড়ে ছেলে মেয়েরা লেখাপড়া করে, অথচ তোমার চোখও নিল না কেউ, শরীরও নিল না!

তুমি মুসলমানের মত লোবানের ধোঁয়ায় ভেসে চুপচাপ কবরে গেলে। আমার বড় মায়া হচ্ছিল দেখে। আমি যে কাউকে ডেকে বলব ‘ওকে নেবেন না, ও ওর শরীর দিতে চেয়েছে মেডিকেল কলেজে’….কিন্তু আমার কথা কে শুনবে ওখানে?

আমি যখন দরজার বাইরে নিস্পন্দ দাঁড়িয়ে ছিলাম, মোহন নামের এক ছেলে তোমাকে আর্ট কলেজে পেটাতে চেয়েছিল একদিন, হুমকি দিয়েছিল তোমাকে যেন ইউনিভার্সিটি এরিয়ায় আর না দেখে, সেই ছেলেই দেখলাম তুমি শুয়ে আছ, তোমার সবচেয়ে কাছে সে বসে আছে।

কী অবাক কাণ্ড, তাই না?

আরো পড়ুন

তুমি কি বেঁচে থাকলে ওকে এত কাছে বসতে দিতে? তুমি কি বেঁচে থাকলে দরজার বাইরে একা দাঁড়িয়ে থাকতে দিতে আমাকে?

খোলা দরজা দিয়ে ঘরের ভেতর যেটুকু দেখা যায়, বড় শখ করে সাজানো আমার সংসারটি দেখছিলাম, ময়মনসিংহ থেকে দুজনে শোবার জন্য খাট বানিয়ে এনেছিলাম, বসবার জন্য চেয়ার, বই রাখবার আলমারি, কবিতা লিখবার টেবিল।

স্বপ্নগুলো তখন টগবগে ঘোড়ার মতছিল, বাঁধ মানত না কিছু। আমার বাবা যখন আদেশ দিলেন ঘরের বাইরে যাওয়া চলবে না, আমি রুখে উঠলাম যাব ব’লে।

মা এসে কেঁদে পড়লেন, আমি মাকে ঠেলে সরিয়ে তোমার কাছে চলে এসেছিলাম। প্রেম বুঝি এমনই দুরন্ত হয়। যেদিন আমার বাবার বাড়ি থেকে বাবা মায়ের আদেশ নিষেধ তুচ্ছ করে তোমার তাজমহল রোডের বাড়িতে উঠেছিলাম, তুমি ছিলে না।

পাগলের মত অপেক্ষা করেছি কখন ফিরবে, ফিরলে রাত একটায়, দরজা খুলে জড়িয়ে ধরতে যাব তোমাকে, দেখি তোমার মুখ থেকে ভুর ভুর করে মদের গন্ধ বেরোচ্ছে, আমি তখন মদ চিনি না, মাতাল চিনি না, ভয়ে কুঁকড়ে ছিলাম সারারাত।

আহা, প্রেমিকের সঙ্গে যাপন করা আমার প্রথম সেই রাত!

আচ্ছা, তোমার লালবাগের সেই প্রেমিকাটির খবর কি, দীর্ঘবছর প্রেম করেছিলে তোমার যে নেলীখালার সঙ্গে? তার উদ্দেশ্যে তোমার দিস্তা দিস্তা প্রেমের কবিতা দেখে আমি কি ভীষণ কেঁদেছিলাম একদিন!

তুমি আর কারও সঙ্গে প্রেম করছ এ আমার সইত না। কি অবুঝ বালিকা ছিলাম, তাই না? যেন আমাকেই তোমার ভালবাসতে হবে, যেন আমরা দুজন জন্মেছিই দুজনের জন্য।

যেন আর কেউ আমাদের হৃদয়ে ঠাঁই পেতে পারে না। আসলে কেউ কি কারও জন্য জন্মায়? আমি অনেকটা জীবন পেরিয়ে এসে এখন বুঝি মানুষ আসলে নিজের জন্য জন্মায়।

তুমি যেদিন বললে তোমার নেলীখালার সঙ্গে তুমি শুয়েওছিলে, আমার ইচ্ছে হয়েছিল আত্মহত্যা করি। তখন আমি অপিয়ামের নাম জানি, যা খেলে খুব নীরবে মরে যায় মানুষ।

যদি বুদ্ধি করে অপিয়াম এনে দিতে হাতে, ওর নির্যাসটুকু পান করে দিব্যি মরে যেতে পারতাম। এক রাতে নেলীখালা এসেছিল বাড়িতে, তুমি ব্যাকুল হয়ে উঠলে, তোমার চোখের তারায় ভালবাসা কাঁপছিল।

আমার একা একা লাগছিল, যে আমি তোমাকে দুদণ্ড চোখের আড়াল করতে পারি না সেই আমাকে তুমি একা ঘরে ফেলে খালার সঙ্গে পাশের ঘরে দীর্ঘ-দীর্ঘ-ক্ষণ কাটিয়ে দিলে।

মাঝে মধ্যে আমার মনে হত আমি বোধহয় খুব স্বার্থপর, তোমাকে আমি কারও সঙ্গে ভাগ করতে চাই না।

তুমি তা বুঝেই হয়ত মুক্ত দাম্পত্যের কথা বলতে, যেন আমার জীবনে তোমাকে এত শক্ত করে না বাঁধি। তুমি বাঁধন আলগা করতে চাইতে কেবল নিজের বেলায়। আমার বেলায় কিন্তু নয়।

আমি ঢাকা ছেড়ে সেদিন চলে গিয়েছিলাম, ময়মনসিংহে আমার ঘরে বাক্স ভর্তি তোমার চিঠিগুলো হাতে নিয়ে জন্মের কান্না কেঁদেছিলাম। আমাদের বিচ্ছেদ ছিল চার বছরের, এত বছর পরও তুমি কী গভীর করে আমার বুকের মধ্যে রয়ে গিয়েছিলে, সেদিন আমি টের পেয়েছি।

একবার আমি ভাইয়ের বাড়িতে গিয়েছিলাম নয়াপল্টন, একা; বিকেলে ফিরে এলে বললে – ‘তুমি কারও সঙ্গে রিক্সায় কলাবাগানের দিকে গিয়েছ?’

বললাম – নাতো! – ‘তবে যে তোমার মত দেখলাম?’ বললাম – ‘ভুল দেখেছ।’ এই ভুল দেখা নিয়ে তুমি কিন্তু ছটফট কম করনি।

আমি কারও সঙ্গে মিশেছি জানলে যদি তোমার কষ্ট হয় তবে তুমি কেন বুঝতে চাইবে না যে আমারও কষ্ট হয় তুমি যখন আমাকে একা রেখে লালবাগ যাও, বাণিয়াশান্তা যাও!

আসলে দাম্পত্য মানেই বন্ধন, এ কখনও মুক্ত হয় না। মুক্ত হলে এটি আর দাম্পত্য থাকে না। আমার সবচেয়ে ভাল লাগত ম্যাচবাক্স টোকা দিয়ে দিয়ে যখন গাইতে ‘আমার মনের কোণে বাউরি বাতাস…’ তখন আমার মনের কোণেও, আমি অবাক হয়ে লক্ষ করতাম বাউরি বাতাস বইছে।

তুমি কি এখন আর গান গাইবে না রুদ্র? সাকুরার কোণার টেবিলে বসে আমাদের কত গানের দুপুর কেটেছে! মাঝে মধ্যে সাকুরার সেই টেবিলটিতে বসি, এক দু পেগ ব্ল্যাক লেবেল পান করি, আর ভেবে খুব হাসি পায় মদ ব্যাপারটিকে একসময় কী ভীষণ ঘৃণা করতাম!

তুমি মদ খেয়েছ শুনলে সারারাত বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদতাম! বালিকা বয়সে সবাই বোধহয় ওরকমই হয়।

যেদিন ট্রাকে করে তোমাকে নিয়ে গেল বাড়ি থেকে, আমার খুব দম বন্ধ লাগছিল, ঢাকা শহরটিকে এত ফাঁকা আর কখনও লাগেনি। বুকের মধ্যে আমার এত হাহাকারও আর কখনও জমেনি।

আমি ঢাকা ছেড়ে সেদিন চলে গিয়েছিলাম, ময়মনসিংহে আমার ঘরে বাক্স ভর্তি তোমার চিঠিগুলো হাতে নিয়ে জন্মের কান্না কেঁদেছিলাম।

আমাদের বিচ্ছেদ ছিল চার বছরের, এত বছর পরও তুমি কী গভীর করে আমার বুকের মধ্যে রয়ে গিয়েছিলে, সেদিন আমি টের পেয়েছি।

তোমার সঙ্গে শেষ দিকে হঠাৎ হঠাৎ দেখা হত, একবার আমার আরমানিটোলার বাড়ি নিয়ে এলাম তোমাকে, আঙুল তোমার পচে যাচ্ছিল, সেটিকে মেডিকেলে নিয়ে পুঁজ রক্ত বার করে ব্যাণ্ডেজ করে দিলাম, বাড়ি এনে ভাত খাইয়ে দিলাম মুখে তুলে।

তুমি শিশুর মত আদর নিলে। আদর পেলে তুমিও শরীর পেতে সেই আদর গ্রহণ কর, কিন্তু হঠাৎ তোমার কী হয় কে জানে, সব আদর পায়ে মাড়িয়ে চলে যাও।

আমার এই দুঃখ কোনওদিন যাবে না, যে, তোমাকে আমি আমার করে কখনও পেতে পারিনি। শেষ দিকে ব্যবসা বাণিজ্যে মার খেয়ে গেলে বলেই হয়ত ওষুধ কিনবার পয়সাও তোমার পকেটে ছিল না, আমার বড় হাসি পায় দেখে এখন তোমার শয়ে শয়ে বন্ধু বেরোচ্ছে, তারা তখন কোথায় ছিল যখন পয়সার অভাবে তুমি একটি সিঙারা খেয়ে দুপুর কাটিয়েছ?

শেষদিকে তুমি শিমুল নামের এক মেয়েকে ভালোবাসতে। বিয়ের কথাও হচ্ছিল। আমাকে শিমুলের সব গল্প একদিন করলে। শুনে, তুমি বোঝনি, আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল। এই ভেবে যে তুমি কি অনায়াসে প্রেম করছ, তার গল্পও শোনাচ্ছ, ঠিক এরকম অনুভব একসময় আমার জন্য ছিল তোমার।

আমি না হয় তোমার বন্ধু নই তোমাকে ছেড়ে চলে এসেছিলাম বলে, এই যে এখন তোমার নামে মেলা হয়, তোমার চেনা এক আমিই বোধহয় অনুপস্থিত থাকি মেলায়, যারা এখন রুদ্র রুদ্র বলে মাতম করে বুঝি না তারা তখন কোথায় ছিল, কেন আমি তোমাকে ত্যাগ করবার পরও আমাকেই তোমার পকেটে টাকা গুঁজে দিতে হত?

মাতম করা বন্ধুদের বেশির ভাগই যে কেবলই তোমার বাংলা-মদ-পানের পার্টনার ছিল, সে আমি জানি।তুমি খুব চাইতে লেখাকে তোমার পেশা করতে। পারোনি।

যারা তোমাকে চেনে না, যখন জিজ্ঞেস করত ‘আপনি কি করেন’, তুমি বলতে ‘লিখি’। ওরা অবাক হত শুনে। ভাবতো লেখা আবার কোনও পেশা হয় নাকি? লেখাকে শেষ অবদি পেশা করেছি আমি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডিজির টেবিলে রেজিগনেশন রেখে চলে এসেছি প্রায় একবছর হল। এর মধ্যে কত কিছু ঘটে গেছে তুমি কি খবর রাখো? আকাশ থেকে তো সব দেখা যায়, তুমি কি দেখ? নাকি সবাইকে খুব ক্ষুদ্র মনে হয়!

পিপীলিকার মত মানুষগুলো হাঁটছে দৌড়াচ্ছে, ঘরবাড়ি গড়ছে, স্বপ্ন দেখছে, মরে যাচ্ছে, তুচ্ছ এই জীবনের সুখের জন্য মরিয়া হয়ে উঠছে-মাঝে মধ্যে বেঁচে থাকবার জন্য মানুষের কাণ্ড দেখে এই জগতে দাঁড়িয়েও আমার হাসি পায়, তুমি কেন হাসবে না, বল!

তুমি তো সকল সীমানার বাইরে চলে গেছ, আমাদের এই ক্ষুদ্র গণ্ডি থেকে অনেক দূরে। তবে কী জানো রুদ্র, মানুষের প্রতি মানুষের ঈর্ষা যে এত মারাত্মক হতে পারে তা সাহিত্য করবার আগে আমার জানা ছিল না।

কলকাতা থেকে আমাকে আনন্দ পুরস্কার দিল, লোকে এ নিয়ে বড় রাগ করল, আমার বই বিক্রি হয় তাতেও ওদের রাগ, আমাকে ডুবিয়ে ভাসিয়ে পত্রিকা বিক্রি করল, হু হু করে বিক্রি হল সব, তাতেও ওদের রাগ কমে না, এখন ধুমসে বই লেখা চলছে আমাকে নিয়ে, কবে কাকে দুটো চিঠি লিখেছি সেই চিঠি নিয়ে বই।

রেজাকে চিনতে না? আমার একটি চিঠির বই বার করছে। কেন এসব হয় বল তো, তুমি তো একবার পত্রিকায় লিখলে তোমার ওপর রাগ করে আমি যেন আর পুরুষমানুষদের বিরুদ্ধে না লিখি, যেন ক্ষমা করে দিই।

পুরুষদের ক্ষমা তো আমি করতেই চাই, কিন্তু তুমি কি পারতে আমার জায়গায় হলে? আমার মত ভুগতে যদি পুরুষ দ্বারা, জানি, খুব ভালো করেই জানি তুমি ক্ষমা করতে না।

তোমার সঙ্গে আমি দেখেছি সবচেয়ে বেশি জমত সাহিত্যের গল্পে; সমাজ পরিবর্তনের জন্য তোমার ভাবনাগুলো, আমার ভাবনার সঙ্গে বড় মিলত।

একবার মনে আছে ‘কালো কাঁচ গাড়ি’ নিয়ে তুমি আমি দুজনেই আধঘণ্টায় একটি কবিতা লিখব বলে স্থির করি। কবিতা লেখা শেষ করে দেখি তোমার আমার কবিতার বিষয় হুবহু এক, বর্ণনা শুধু ভিন্ন।

সাহিত্যের আড্ডা যখন হয়, আমার বাড়িতেই মাঝে মাঝে আসর বসাই, তোমার অভাব খুব অনুভব করি, হঠাৎ হঠাৎ আনমনা হয়ে যাই যে তুমি থাকলেবোধহয় সেই গানটি ধরতে, ‘আমার মনের কোণে বাউরি বাতাস…’।

কতদিন আমার মনে বাউরি বাতাস বয় না, কতদিন আমি আর আবেগে আগের মত কাঁপি না, যেমন কেঁপে উঠতাম তোমার সামান্য স্পর্শে। সবচেয়ে যে জিনিসটি আমি বেশি চাইতাম দুজনের মধ্যে, তা নিখাদ ভালবাসা আর বিশ্বাস।

তুমি দিন দিন লুকিয়ে লুকিয়ে সেটিরই খেলাপ করতে। তুমি করতে সে তোমার অক্ষমতা, তবে আমি কিন্তু মরতে দিইনি তোমার প্রতি আমার তীব্র ভালবাসাকে। আমি রাগ করেছি, তালাকনামা পাঠিয়েছি, কিন্তু আবেগ একফোঁটা কমেনি।

একা একা বুকে করে সব বয়ে বেড়িয়েছি। এখনও তোমার পুরোনো চিঠিগুলোদেখলে হৃদয়ে ধুকপুক বাড়ে। মনে পড়ে তোমার এক একটি চিঠি আমাকে এক সমুদ্র সুখে ভিজিয়ে রাখত।

কত কী যে ঘটে গেল, এখন আমার জীবন জুড়ে তুমি নেই তোমার চিঠি আছে, ‘তুমি নেই তোমার বন্ধন পড়ে আছে’র মত। চিঠিগুলো দুলাল নামের এক ছেলে চেয়েছিল ছেপে দেবার জন্য, দিইনি।

একান্ত যা আমার, তা আমি সাত লোককে পড়াবো কেন? শেষদিকে তুমি শিমুল নামের এক মেয়েকে ভালোবাসতে। বিয়ের কথাও হচ্ছিল। আমাকে শিমুলের সব গল্প একদিন করলে। শুনে, তুমি বোঝনি, আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল।

এই ভেবে যে তুমি কি অনায়াসে প্রেম করছ, তার গল্পও শোনাচ্ছ, ঠিক এরকম অনুভব একসময় আমার জন্য ছিল তোমার। আজ আরেক জনের জন্য তোমার অস্থিরতা, নির্ঘুম রাত কাটাবার গল্প শুনে আমার কান্না পায় না বল?

তুমি শিমুলকে নিয়ে কী কী কবিতা লিখলে তা দিব্যি বলে গেলে, আমাকে আবার জিজ্ঞেসও করলে- কেমন হয়েছে? আমি বললাম – খুব ভাল।

তুমি হঠাৎ হঠাৎ বড় অকপট ছিলে, যে জিনিসটি আমার বড় ভাল লাগত। শিমুল মেয়েটিকে আমি কোনওদিন দেখিনি, তুমি তাকে ভালবাসো যখন নিজেই বললে, জানি না আমার ওপর শোধ নেবার জন্যই বললে কি না, আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল, যে কষ্ট তোমাকে আমি বুঝতে দিইনি।

কারণ তোমাকে ছেড়ে কারও সঙ্গে এক ঘরে হয়ত আমি বাস করেছি কিন্তু ভালবাসতে পারিনি, ভালবাসা যে যাকে তাকে বিলোবার জিনিস নয় এ কথা তুমি যদি না বোঝ, পাছে আমাকে দোষী কর, তাই বলিওনি শত কোলাহলে ডুবে থেকেও আমার একাকীত্বের গল্প।

কেবল তোমার গল্পই শুনে গেছি। শুনতে শুনতে হেসেছি, হাসতে হাসতে চোখ মুছেছি আঁচলে।

ঠাঁই ছিল না আমার সোনার তরীতে, এঘাটে ওঘাটে কেবল দিয়ে ফিরেছি, সব দিয়ে নিজের ঘাটে শূন্য তরী ভিড়িয়েছি। জীবন ভর সকলে কেবল দুহাত ভরে নিল। তা নিক, আমি যে দিতে পারি এই আমার সুখ। মানুষ তো শেষ অবধি মানুষের জন্যই।

তোমাকে ছাড়া আর দুটো পুরুষ ছুঁয়েছি বলে লোকে আমাকে চরিত্রহীন বলে। তুমি যে মালিটোলায়, লালবাগে, টানবাজারে, বাণিশান্তায় এত নারী ছুঁয়েছ তোমাকে কিন্তু কেউ চরিত্রহীন বলে না। মেয়েদের বেলায় যত ছোঁয়াছুঁয়ির বিচার। মেয়েদের বেলায় যত ছিছি, যত আহা আহা, গেল গেল রব।

মেয়েরা যত বড় কবি হোক, লেখক হোক, বিজ্ঞানী কী বৈমানিক হোক, আগে সতীত্বটা ঠিক রাখতে হবে তারপর সব। দিন দিন এমন হচ্ছে যে মেয়েরা সতী হবার চেষ্টাই প্রাণপণে করে যায়, অন্য কিছু হবারপেছনে সময় অত ব্যয় করে না।

মেয়েরা আসলে সতীত্ব বেঁচে খায়। আর এই সতীত্ব বেঁচে খাওয়ায় পুরুষেরা বড় প্রীত থাকে মেয়েদের প্রতি, আর মেয়েরাও এমন নির্বোধ যে পুরুষদের আরও প্রীত করবার জন্য জীবনভর ব্যস্ত থাকে।

অধিকাংশ মেয়েদের তো নিজের খাবার নিজে যোগাড় করার যোগ্যতা নেই, পরের ওপর খায়। পরনির্ভর মেয়েরা যখন সতীত্বের বড়াই করে, দেখে এত রাগ হয় আমার কী বলব!

আকাশের সঙ্গে কত কথা হয় রোজ। কষ্টের কথা, সুখের কথা। এখনও রাতের আকাশ পেলে কাজকম্ম ফেলে কিশোর-বেলার মত নক্ষত্র গুনি।

মেয়েরা যত বড় কবি হোক, লেখক হোক, বিজ্ঞানী কী বৈমানিক হোক, আগে সতীত্বটা ঠিক রাখতে হবে তারপর সব। দিন দিন এমন হচ্ছে যে মেয়েরা সতী হবার চেষ্টাই প্রাণপণে করে যায়, অন্য কিছু হবারপেছনে সময় অত ব্যয় করে না। মেয়েরা আসলে সতীত্ব বেঁচে খায়

একদিন আকাশ ভরা জ্যোৎস্নায় গা ভেসে যাচ্ছিল আমাদের, তুমি দুচারটে কষ্টের কথা বলে নিজের লেখা একটি গান শুনিয়েছিলে – ‘ভাল আছি ভাল থেকো আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো।’

মংলায় বসে গানটি লিখেছিলে। মনে মনে কার চিঠি তুমি চেয়েছিলে? আমার? নেলীখালার? শিমুলের?অনেকদিন ইচ্ছে তোমাকে একটি চিঠি লিখি।

একটা সময় ছিল, তোমাকে প্রতিদিন চিঠি লিখতাম, তুমিও লিখতে প্রতিদিন। তোমার অনেকগুলো ঠিকানা ছিল, মংলার, মিঠেখালির, ঢাকার। আর সেবার আরমানিটোলার বাড়িতে বসে দিলে আকাশের ঠিকানা।

তুমি পাবে তো এই চিঠি? আকাশের সঙ্গে আমারও বন্ধুত্ব ভাল। যে কোনও দিন হুট করে চলে যাব তুলোর মত উড়ে বেড়াতে। না পড়া বইগুলো ফেলে, গোছা গোছা স্বপ্ন ফেলে, প্রিয় মানুষ ফেলে, তুমি যেমন চলে গেছ, এমন তো আমিও যাব।

নক্ষত্রগুলোর সঙ্গে এক্কা দোক্কা খেলব। জগতের দিকে চোখ রেখে আমার কি তখন খানিকটা দুঃখ হবে এই ভেবে যে কিছুই দেখা হয়নি যা দেখার কথা ছিল! হবে হয়ত, জীবন এবং জগতের তৃষ্ণা তো মানুষের কখনও মেটে না।

তবু মানুষ আর বাঁচে কদিন, বল? দিন তো ফুরোয়। আমারও কি দিন ফুরোচ্ছে না? তুমি ভাল থেকো। আমি ভাল নেই।

ইতি সকাল পুনশ্চ- আমাকে সকাল বলে ডাকতে তুমি। কতকাল ওই ডাক শুনি না! তুমি কি আকাশ থেকে ‘সকাল, আমার সকাল’ বলে মাঝে মধ্যে ডাকো? নাকি আমি ভুল শুনি !

গল্পগ্রন্থ “দুঃখবতী মেয়ে” থেকে সংকলিত

Comments to: রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে লেখা তসলিমা নাসরিনের চিঠি

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    Attach images - Only PNG, JPG, JPEG and GIF are supported.

    Login

    Welcome to Chithipotro

    You are couple of steps away from being one of our family member
    Join Us