প্রীয়তমেষু,

সম্বোধন টা মনে হয় ঠিক হল না। তোমাকে এ নামে ডাকার দুঃসাহস আর সৌভাগ্যই বল কোনটাই আমার ছিল না, এখনও নেই। তবু ভুলেই ডেকে ফেললাম।

জানই তো ভুল নিয়ে মাতামাতি করে লাভ নেই। ভুল তো তুমিও করেছিলে একদিন। আমি কি মাতামাতি করেছি? ভুলে গেছো? ভোলাটাই স্বাভাবিক। ভুলকুমারী বলে কথা!

আগেও তো একটুতেই আমাকে ভুলে যেতে! ‘তোমাকে এখন আমার মনে পড়ছে না। তারমানে আমি তোমাকে ভুলে গেছি!’- তোমার মেসেজটা পড়ে সেদিন খুব হেসেছিলাম।

মনে রাখার ভয়ে মানুষ যে এভাবে ভুলে যায় সেদিনই প্রথম জেনেছিলাম। আদর করে তোমার নাম রেখেছিলাম-‘ভুলকুমারী’! নামটা তোমার খুব পছন্দ হয়েছিল! এটাও ভুলে গেছ নিশ্চয়? আমিও সব ভুলে গেছি। আমার শৈশব, কৈশোর, যৌবন সব!

খুব ছোটবেলায় একবার তোমাদের বাসায় গিয়েছিলাম। তুমি বড় একটা কুলোতে করে ধান পরিষ্কার করছিলে। আশেপাশে কাউকে ঘেষতে দিচ্ছিলে না।

কিন্তু আমি যাওয়া মাত্র পিড়ি এগিয়ে দিয়েছিলে বসার জন্য। এমন আতিথিয়তাকেও আমি খুব সহজেই ভুলে গেছি। এরপর যেদিন তোমার সাথে দেখা হল সেদিন তুমি অনেকটা বড় হয়ে গেছো। ক্লাস ফাইভে পড়। আমি সিক্সে। দেখা হল কিন্তু কথা হল না। তুমিও বললে না, আমিও না। আমাদের কথা বন্ধ থাকল বারো বছর!

এ বার বছরে অনেকবার তোমার সাথে দেখা হয়েছে। সঙ্কোচ কাঁটিয়ে তুমি কয়েকবার কথা বলার জন্য এগিয়ে এসেছিলে। ‘কেমন আছো?’ বাক্যটাও বলেছিলে কয়েকবার কিন্তু আমি উত্তর দিতে পারিনি। আমার জিহ্বা অকারণে সেদিন অনেক বেশি ভারী হয়ে গিয়েছিল।

কারণটা কিছুদিন পর উদঘাটন করেছিলাম। এক বন্ধু বলেছিল আমি নাকি তোমার প্রেমে পড়েছি! বন্ধুর কথা সেদিন হেসেই উড়ে দিয়েছিলাম। তারপর সত্যি সত্যি একদিন তোমার প্রেমে পড়ে গেলাম! তুমি জানলে না।

তোমার এসএসসির রেজাল্ট হল। লোকমুখে তোমার রেজাল্ট শুনলাম। রেজাল্ট ভালো করনি। কেন যেন সেদিন তোমার রেজাল্ট শীটটা দেখার খুব ইচ্ছে করছিল। তোমার বাসায় যে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করব সে সাহসটুকুও আমার ছিল না।

তোমার আব্বু-আম্মুই বা কি ভাববে? না ভুল বললাম। আমি সেদিন তোমার আব্বু-আম্মুকে ভয় পায়নি, ভয় পেয়েছিলাম তোমাকে। যদি বুঝে যাও! তারপরও সেদিন আমি তোমার রেজাল্ট শিট দেখেছিলাম।

একটি রোলের বদলে আমাকে কয়েক হাজার রোল চেক করতে হয়েছিল সেদিন। তারপর একদিন তুমি এইচএসসি পাশ করলে। এর মাঝে অনেকদিন তোমার খবর রাখা হয়নি। ধরেই নিয়েছিলাম তুমি হারিয়ে গেছো।

হঠাৎ একদিন একটা আননোন নাম্বার থেকে মেসেজ এল। সাধারণত আননোন নাম্বার থেকে মেসেজ এলে আমি উত্তর করিনা। সেদিন তোমার সম্বোধন দেখে কেন যেন সন্দেহ হল। উত্তর করলাম।

যখন নিশ্চিত হলাম যে এইটা তুমি তখন আমার কি অবস্থা হয়েছিল সেটা বলে বোঝাতে পারব না। অনেক রাত অবধি মেসেজিং করেছিলাম আমরা। শুধু সেদিন নয়, পরদিন, তারপরদিন, তারপরদিন এবং তারও পরে অনেকদিন।

স্বপ্নের মত দিন গুলি কেটে যাচ্ছিল। তখন বোধহয় রমযান মাস ছিল। ইফতারের পর শুরু হত, আর চলত সেহরি পর্যন্ত। সেবারের রমযান মাসটা না ঘুমিয়েই কেটে দিয়েছিলাম আমরা।

খুব বেশীদিনের কথা না। একটু চেষ্টা করলেই হয়তো মনে করতে পারবে। একদিন জিজ্ঞেস করলে কোন কালে কোন মেয়েকে আমার পছন্দ হয়েছিল কি না? বলেছিলাম হ্যা! তুমি জানার জন্য উদগ্রীব ছিলে, আমি বলব বলব করেও বলতে পারিনি।

তবে যেদিন বলেছিলাম সেদিন তোমার শোনার সব রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে। আমিও নিরুপায়, তুমিও নিরুপায়। একদিন সাহস করে তোমাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তোমার কোন পছন্দের কেউ আছে কিনা।

উত্তরটা মন খারাপের ছিল। বলেছিলে তোমাকে বাবা-মার পছন্দেই বিয়ে করতে হবে, অন্য চিন্তার সুযোগ নেই। তোমার অবস্থা দেখে তোমাকে ঘাটানোর সাহস আর আমার হয়নি।

একদিন তোমাকে ফোন করেছিলাম। আটত্রিশ মিনিট কথা বলেছিলাম। আমি বকবক করছিলাম আর তুমি সুবোধ শ্রোতার মত মনযোগ দিয়ে শুনছিলে। অবাক হয়েছিলাম। আমার কথা এত মনযোগ দিয়ে কেউ কখনো শোনেনি আগে।

চুড়ান্ত অবাকটা তখন হলাম যখন জানলাম তুমি আমার কথামত মোবাইল নাম্বারটাও চেঞ্জ করেছো! যতই দিন যাচ্ছিল আমি যেন তোমাতে ততই মুগ্ধ হচ্ছিলাম। রমযান শেষ হয়ে গেল। ইদুল ফিতর এল। দেখতে দেখতে ইদুল আযহাও চলে এল।

শুনলাম তোমাকে দেখতে বর পক্ষ থেকে লোক এসেছে। খবরটা তুমিই জানালে। হালকা শক পেলাম। এমন কিছু যে একটা হবে সেটা কয়েকদিন থেকে আন্দাজ করেছিলাম। তোমাকে বুঝি বলেওছিলাম একদিন।

হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলে। আমার সাথে বাজিও ধরলে। পড়াশুনা শেষ করার আগে তোমার বিয়ে হবে না। আমি বললাম আগামী ছ’মাসের মধ্যেই তোমার বিয়ে হবে। কথাটা কি ভেবে বলেছিলাম মনে নেই। তবে তাই হল।

একদিন সকাল বেলা ফোন দিয়ে জানালে বাজিতে আমি জিতে গেছি। ধক করে একটা ধাক্কা লাগল বুকে। এই প্রথম জয়ের আনন্দ টা বিস্বাদ লাগল। অনেক কষ্টে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করলাম।

বুক ভরে আশির্বাদ করলাম তোমায়। তুমি রেগে ফোনটা কেটে দিলে। তোমার এনগেজমেন্টের আগের দিন তোমার সাথে সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে দিলাম। তুমিও কিছু বললে না। বললাম, তোমাকে খুব মিস করব।

তুমিও ঐ ধরণের কিছু একটা বললে। সময়টা আমার অনেক কষ্টে কাটল। তোমার কেমন কেটেছে জানিনা। এনগেজমেন্টের ছবিগুলো দেখে আন্দাজ করে নিয়েছি। সময়টা বোধহয় খুব খারাপ কাটেনি তোমার।

তারপর একদিন তোমার বিয়ে হয়ে গেল। তোমার বিয়েতে যাওয়ার ইচ্ছে আমার কোন কালেই ছিল না। ভাগ্যের লিখন না যায় খণ্ডান। তোমার গায়ে হলুদের ঠিক একটু আগে তোমার বাসায় গিয়ে উপস্থিত হলাম। নিজ হাতে তোমার হলুদ স্টেজ সাজালাম। তুমি বসে বসে আমার ফুল গাঁথা দেখছিলে।

প্রথমবার তোমার প্রেমে পড়ে যেমন বাক প্রতিবন্ধী হয়েছিলাম সেদিনও আমার একই অবস্থা হল। সবাই আনন্দে চিৎকার চেঁচামেচি করছে, তুমিও খটখট করে হাসছো। আমিও হাসলাম।

কিন্তু কেন যেন খটখট শব্দ হল না। তারপরের দিনগুলো কিভাবে কেটে গেছে মনে রাখিনি। দিন তো আসেই কেটে যাওয়ার জন্য। মনে রেখে লাভ কি বল? তবে যত দূর জানি তুমি ভালো আছো। আমিও নিঃসন্দেহে ভালো আছি। কোন অপেক্ষা নেই, রাত জাগা নেই, মন খারাপ নেই। শুধু ভালো থাকা আর ভালো থাকা।

ইতি

তোমার ঘাসকুমার

পুনশ্চঃ ঘাসকুমার নামটা কিন্তু তোমারই দেয়া। ফসলের মাঠের অবাঞ্ছিত আগাছা, গ্রামের মেঠো রাস্তায় দেখলে শহুরে পথিক মাঝে মাঝে একটু আবেগে উচ্ছ্বসিত হয়। যেমনটি তুমি হয়েছিলে।

Comments to: তোমার কাছে খোলা চিঠি

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    Attach images - Only PNG, JPG, JPEG and GIF are supported.

    Login

    Welcome to Chithipotro

    You are couple of steps away from being one of our family member
    Join Us