৪-৪-৯০

কল্যাণীয়েষু দ্বিজু বাবু [দ্বিজেন শর্মা],

তোমার ৩০.১২.৮৯–এর চিঠি আমি পেয়েছিলাম ৯.৯.৯০ তারিখে। তুমি দেখা করে গেলে ১৯.০৩.৯০ তারিখে, দেখা হলো। কিছু কথা হলো। কিন্তু তোমার চিঠির জবাব দেওয়া হয়নি। তাই আজ লিখতে বসলাম।

আজ আমার বড় আনন্দের দিন। আমাদের মহিলা পরিষদ আজ ২০ বছর পূর্তি হলো। আজ সকালে জ্বর-সর্দি-কাশি-বুকে ব্যথা নিয়ে ৪ ঘণ্টা মিটিং করে এলাম। বহু মহিলারা এসেছিলেন। নারী, তথা মানবকল্যাণের ব্রত নিয়ে মহিলা পরিষদ আরও দৃঢ়তার সাথে সামনে চলবে, এই শপথে আমি আস্থাবান।

তোমার চিঠিটি আমাকে আনন্দ দিয়েছে। তুমি প্রশ্ন রেখেছিলে, পদ্মা–মেঘনা–যমুনায় আমি উপস্থিত নেই কেন। শুধু পদ্মা–মেঘনা–যমুনায় নয়, ’৭৭ যখন আমি আমেরিকায় ছিলাম, তখন বাংলা গবেষক এক আমেরিকান লেখক আমাদের বলেছিলেন, ‘তোমাদের লেখক সৈয়দ আলী আহসান ৩ খানা বাংলা সাহিত্যবিষয়ক বই লিখেছেন।

অনেক জনার নাম আছে তাতে, কিন্তু আপনার উল্লেখ কোথাও নেই, অবশ্য তাতে করে আপনার কোনো ক্ষতি বৃদ্ধি হয় নাই, লেখকের অজ্ঞতারই প্রমাণ পেলাম আমরা।’ আমি কোনো উত্তর দিইনি, ওসব আমার ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।কিন্তু যে আহসান হাবীবকে এককা [একা?] তার মেস থেকে বসন্তরোগে আক্রান্ত অবস্থায় আমি কলকাতায় আমার বাড়িতে এনেছিলাম, তখন আমার বড় ছেলে ৩–৪ মাসের আমার কোলে।

অনেকেই তখন আমাকে সাবধান করেছিলেন, তার পরেও ’৫৫-তে আবার কলকাতা থেকে বিতাড়িত হয়ে অসহায় অবস্থায় ঢাকা আসার পর হাবীবের পুনর্বাসনের জন্য সপ্রাণ চেষ্টা করে রেডিওতে কাজের সংস্থানের উপায় করে দিয়েছিলাম।

তার লেখায় বা কলকাতা থাকাকালীন ও পরে ’৪৭-এ ঢাকা এসে অসহায় কামরুল হাসান আমার কাছেই থাকল, ভাষা আন্দোলনের সময় কাগজ-রঙের অভাবে খবরের কাগজে চুন-হলুদ-কয়লার কালি দিয়ে পোস্টার এঁকে আমার বাড়ি থেকেই মিছিলে যাওয়া হতো। তার জীবনীতে কোথাও আমার উপস্থিতি নেই।

অসহায় কিশোর ফররুখ আহমদ যাদবপুর থেকে রোজ আমার পার্ক সার্কাসের বাড়িতে এসে আশ্রয় খুঁজত, শান্তি, সাহস পেত, কবিতা লিখত, তার জীবনীতেও কোথাও আমার উল্লেখ নেই, থাকবে না। তা হোক, কিন্তু আমার দুঃখ, বর্তমান মেয়েরা কত ভালো লিখছে, অথচ তাদের লেখার আলোচনা-সমালোচনা তো হচ্ছেই না, বরং এক রকম উপেক্ষাই করা হচ্ছে। আমার তো এখন ফালতু জীবন।

সে যাহোক, এ দেশে সবকিছুর অবক্ষয় আমাকে বড় দুঃখ দেয়। আরও লিখতাম, হাতের লেখা ভালো নয়, তোমার পড়তে কষ্ট হবে। আমার এখন লিখতে হাত কাঁপে, তবুও কিছু লিখি। কিন্তু স্বাধীনতার কবিতা আমি লিখি না।

খুব দুঃখ বোধ করছি। তোমাকে, দেবীকে [দ্বিজেন শর্মার স্ত্রী] নিজে রেঁধে খাওয়াতে পারলাম না, তোমার কথাসব সময়ই মনে পড়ে। তোমরা সোয়াস্তিতে থাকো, ভালো থাকো এই দোয়া করি। বাচ্চাদের আমার স্নেহাশিষ দিয়ো, ওরা আমাকে চিনবে তো? কামাকে [সুফিয়া কামালের কবিতার রুশ অনুবাদক] আমার সম্ভাষণ জানায়ো। স্নেহাশিষ রইল।

সুফিয়া কামাল

* আমার ছেলে শামীমের খুব ইচ্ছা ছিল তোমাকে নিয়ে গাছগাছালির আলোচনা করার, তা-ও হলো না।

চিঠি কৃতজ্ঞতা: সুমন সাজ্জাদ
অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, জাবি

Comments to: বেগম সুফিয়া কামালের অপ্রকাশিত চিঠি

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    Attach images - Only PNG, JPG, JPEG and GIF are supported.

    Login

    Welcome to Chithipotro

    You are couple of steps away from being one of our family member
    Join Us