শামসুন নাহার-কে লেখা চিঠি
81, Pan Bagan Lane
Calcutta
4.2.29
চিরআয়ুষ্মতীসু!
ভাই নাহার! কাল ঠাকুরগাঁ (দিনাজপুর) থেকে এসে তোমার চিঠি পেলাম। পেয়ে যেমন খুশি হলাম, তেমনই একটু অবাকও হলাম। খুশি হলাম তার কারণ, আমি তোমায় চিঠি দিইনি এসে, দিয়েছি বাহারকে। অসম্ভাবিতের দেখা সকলের মনেই একটু দোলা দেয় বই-কী!
অবাক হলাম, আমাদের দেশে, বিশেষ করে আমাদের সমাজের কোনো কোনো বিবাহিতা মেয়ে একজন অনাত্মীয়কে (আমি রক্তের সম্পর্কের কথা বলছি ভাই, রেগো না যেন এ কথাটাতে) চিঠি লিখতে সাহস করে, তা সে যত সহজ চিঠিই হোক। তাছাড়া, তুমি স্বভাবতই একটু অতিরিক্ত Shy বা timid।
সত্যি বলতে কি, তোমার চিঠি পেয়ে বড্ড বেশি আনন্দিত হয়েছি।
সলিম কি ফিরেছে? ওরা অর্থাৎ বাহার, সলিম কখন আসবে কলকাতায়?
সাতই তারিখে চিঠি দিয়েছ এবং লিখেছ ‘কালই কবিতাগুলো পাঠাব’। আজ চোদ্দ তারিখ। আমার মনে হয় তোমার ‘কাল’ হয়তো কোনো অনাগত দিনকে লক্ষ করে লিখিত হয়েছিল, যার কোনো বাঁধা-ধরা তারিখ নেই!
আমি জানি তোমার শরীর কীরকম ভেঙে গেছে, এর ওপর যদি ওসব রাবিশের তোমাকেই নকল-নবিশ হতে হয় তাহলে আমার দুঃখের আর অবধি থাকবে না। একটু পড়তেই তোমার মাথা ধরে, আর লিখতে গেলে মাথা হাত-পা সবগুলো হয়তো conspiracy করে ধরবে।
আমার অগতির গতি মেতু মিয়াঁ তো আছেন। তাঁকে দিয়েই না হয় কপি করিয়ে পাঠিয়ে দাও। নইলে ফাল্গুনের কাগজে দেওয়া যাবে না।
কপি প্রেসে দিতে পারছি না লেখাগুলোর জন্য। বাহারকে আর বলব না। আশা করি তোমায় এ-ভার দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকব। তুমি একটু আদেশ দিয়ে মেতু মিয়াঁ, হুক্কা মিয়াঁ অ্যান্ড কোম্পানিকে দিয়ে এটা করিয়ে নিয়ো।
দুপুরটা তোমার বাচ্চা-ই-সাক্কাওর৩ জন্যে কেমন যেন উদাস ঠেকে। ওই সময়টুকু এক মুহুর্তের জন্য সে আমায় সব ভুলিয়ে দিত। ওকে আদর জানিয়ো আমার।
নানি আম্মার কান্নার কানায় ভাটির জলের দাগ পড়েছে হয়তো এতদিনে। ওঁকে বোলো আবার জোয়ারের জন্য প্রতীক্ষা করতে। আমার সাম্পানের সব গান আজও লেখা হয়নি। আমার খেয়াপারের শেষ গান হয়তো তিনি শুনে যাবেন।
কলকাতার ঘেরা-টোপে ঘেরা খাঁচায় বন্দি হয়ে নব ফাল্গুনের উৎসব দেখতে পাচ্ছিনে চোখ দিয়ে, কিন্তু মন দিয়ে অনুভব করছি। নীল আকাশ তার মুখচোখ বোধ হয় একটু অতিরিক্ত ধোয়া-মোছা করছে, কেননা তার মুখে যখন তখন সাবানের ফেনা– সাদা মেঘ ফেঁপে উঠতে দেখছি।
তার ফিরোজা উড়নি বনে বনে লুটিয়ে পড়ছে। মাধবী লতায় পুষ্পিত বেণি, উড়ন্ত ভ্রমরের সারিতে আঁখিপল্লব, পায়ের কাছে দিঘিভরা পদ্ম। সমস্ত মন খুশিতে বেদনায় টলমল করছে।
রোজায় বোধ হয় আর কোথাও যাচ্চিনে। তবে বলতেও পারিনে ঠিক করে।
আম্মা কখন নোয়াখালি যাচ্ছেন হবু বউ দেখতে? ভালো দিনক্ষণ দেখে পাঠিয়ো। মহী খুব গলা সাধছে, না? অর্থাৎ আমি চলে এলেও আমার ভুত এখনও চড়াও করে আছে?
আমার বন্ধু সিন্ধু, কর্ণফুলির খবর তো তুমি দিতে পারবে না, তবে ‘গুবাক তরুর সারি’র খবর নিশ্চয় দিতে পারবে। ওরা যেন কত শুকিয়ে গেছে, ওদের আঁখি-পল্লবে হয়তো আজকাল একটু অতিরিক্ত শিশির ঝরে, বাতাসে হয়তো একটু বেশি করে শ্বাস ফেলে।
মনের চক্ষে ওদের আমি দেখি আর কেমন যেন ব্যাকুল হয়ে উঠি। তোমাদের পাড়ার ফাল্গুনী কোকিলরা হয়তো ভোরে তেমনি কোলাহল করে ঘুম ভাঙিয়ে দেয়।
এতদিনে হয়তো আমের শাখাগুলি মুকুলে মুকুলে নুয়ে পড়েছে, গন্ধে তোমাদের আঙিনা ভারাতুর হয়ে উঠেছে। আমি যেন এখান থেকে তার মদগন্ধ পাচ্ছি।
আমার বুক-ভরা স্নেহাশিস নাও। নানিআম্মা, আম্মা প্রভৃতিকে সালাম; অন্য সকলকে ভালোবাসা, শুভাশিস দিয়ো। ইতি–
তোমার–
‘নুরুদা’
No Comments
Leave a comment Cancel