চিঠি লেখকঃ মরহুম আবদুল মালেক। ফেনী জেলা চেম্বার অব কমার্স ও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি । মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি ফেনীর বিলোনিয়া ট্রানজিট ক্যাম্পের প্রধান ছিলেন । মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণের জন্য ফেনীর মধুপুরের নিজ গ্রাম থেকে রওনা হয়ে বিলোনিয়া ট্রানজিট ক্যাম্পে আসেন । ক্যাম্পে পৌছানোর পর এই চিঠিটি লেখেন ।
চিঠি প্রাপকঃ মেয়ে জানু
চিঠিটি পাঠিয়েছেনঃ ফরহাদ উদ্দিন আহাম্মদ ।
চিঠি লেখকের নাতি এবং জানুর দ্বিতীয় পুত্র ।
২৮-৫-১৯৭১
স্নেহের মা জানু,
আমার আন্তরিক স্নেহ ও ভালোবাসা নিও। তোমার শাশুড়ি আম্মাকে আমার সালাম দিও । দুলা মিয়া, পুত্রা মিয়ারা, ঝিয়ারীগণ ও সোহরাব, শিমুলকে আমার আন্তরিক স্নেহ ও ভালোবাসা জানাইও। এখানে খাওয়াদাওয়ার যেমন অসুবিধা, তেমন লোকের ঝামেলাও অনেক বেশি ।
সেদিন তোমাদের বাড়ি হইতে আসিতে কোনো অসুবিধা হয় নাই । দেড় ঘন্টার মধ্যে বিলোনিয়া পৌছিয়াছি । তোমাদের বাড়ি হইতে যেদিন ফিরিয়াছি সে রাতে মোটেই ঘুম হয় নাই ।
দুলা মিয়া, তুমি এবং আমার স্নেহের নাতিদের কথা মনে পড়ার সাথে সাথে ২৩-০৪-৭১ ইং তারিখে (…) তোমার মাতা, রেখা, রেণু, রুবি, রৌশন ও তার চারটি ছেলে । আমার বৃদ্ধ ও রুগ্ন আব্বা ও জীবনের যৎসামান্য আড়াই লক্ষ টাকার নগদ টাকা ও সম্পদ সবকিছুর কথা ।
দোকান, বাসা ও মালপত্র ছাড়াও সরকারের ঘরে ৮০ হাজার টাকার মতো পাওনা রহিয়াছে । তা পাওয়া যাইবে কি না যাইবে তাহার কথা বেশি ভাবি কি না । বাংলাদেশে যখন ফিরিতে পারি এবং যদি কখনো ফিরি তবে ফেলিয়া আসা ছাইয়ের উপর দাঁড়াইয়া আবার নতুনভাবে গড়িয়া তোলার চেষ্টা করিবার আশা নিয়া বাঁচিয়া আছি ।
জানু, কয়েকটা কথা প্রায় দিন বারবার মনে পড়ে । এই কথাগুলো ভুলিতে পারিব দেশে ফিরিবার পরিবেশ সৃষ্টি করিয়া, দেশে ফিরিয়া গিয়া, নতুবা মৃত্যুর পর । ২২/৪/৭১ ইং তারিখ দিবাগত রাত্র দেড়টার সময় দেশের বাড়ি হইতে বাহির হওয়ার সময় সকলের থেকে বিদায় নেওয়ার পর যখন আব্বার থেকে বিদায় নিতে যাই তখন আব্বা আমাকে কোনো অবস্থায় যাইতে দিবেন না বলিয়া হাত চাপিয়া ধরেন এবং জোরে কাঁদা আরম্ভ করিয়া দেন ।
বাড়িতে বা দেশে থাকা নিরাপদ নহে ভাবিয়া রৌশন এবং অন্যরা জোর করিয়া আব্বার হাত হইতে আমাকে ছিনাইয়া লয় এবং আল্লাহ্র হাতে সঁপিয়া দিয়া রাত্র ২ ঘটিকার সময় সকলের কাঁদা রোল ভেদ করিয়া তোমার আম্মার সাথে দেখা করিবার জন্য কায়ুমকে সাথে লইয়া কচুয়ার পথে রওনা হই ।
কচুয়া একদিন থাকিয়া তোমার আম্মা, রেখা, রেণু ও রুবিকে কাঁদা অবস্থায় ফেলিয়া রাত্র ৪ টার সময় রওনা হইয়া তোমার নিকট আসিয়া পৌছাই । বাড়ি হইতে রওনা হওয়ার পূর্বেই কথা হইয়াছিল যে রৌশন পরের দিন সকালে চর চান্দিয়া রওয়ানা হইয়া যাইবে ।
এই ঋতুতে যে কোনো দিন সে এলাকায় থাকার অন্য বিপদ ছাড়াও ঘূর্ণিঝড়ের বিপদ যেকোনো মুহূর্তেই হইতে পারে । কোনো গত্যন্তর না থাকায় আমার প্রাণের ‘মা’ রৌশন ও সোনার বরন চারজন নাতিকে সমুদ্রের ঢেউয়ের মুখে ঠেলিয়া দিতে বাধ্য হইয়াছি ।
তুমিও জানো যে তোমার মাতার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমি তাহাদিগকে উক্ত কারণে বাসায় রাখিতে চাহিতাম । তোমাদের সকলের মুখ উজ্জ্বল করিবার জন্য নিজের চেষ্টায় যাহা গড়িয়া তুলিয়াছিলাম, তাহা আজ অবস্থার গতি পরিবর্তনের সাথে সাথে সব ধূলিসাৎ হইয়া গেল ।
সবকিছু ভুলিবার চেষ্টা করিয়াও ভোলা যায় না । ‘মা’, তোমাদেরকে অন্তরে অধিক ভালোবাসি । সে ক্ষেত্রে আজ আমার পাঁচ মেয়েকে ভিনদেশে রাখিয়া আসিয়া স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলিতে পারিতেছি না । জানু, আজকে তুমি আমার একমাত্র নিকটে, তাই তোমাকে দেখিবার চেষ্টা করি ।
দুলা মিয়া, তুমি ও সোহরাব, শিমুলকে সামনে দেখিতে পাইলে একটু আনন্দ পাই এবং কিছুটা মনের ভাব লাঘব হয় । আত্মীয়স্বজন সকলের আগ্রহ দেখিয়া নিজেকে হালকা বোধ করি, চিন্তামুক্ত থাকি । কায়ুম, মোতা, কবীর, আপসার ও আক্তার সব এখানে আছে ।
ক্যাম্পে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করিতেছে । আশা, কয়েক দিনের মধ্যে যাওয়া হইবে । সোহরাব ও শিমুলের প্রতি লক্ষ রাখিয়ো । আমি ভালো । তোমাদের কুশল কামনা করি ।
ইতি তোমারই বাবা
No Comments
Leave a comment Cancel