সৈয়দ আবুল হোসেন
সংসদ সদস্য
২২০, মাদারীপুর-৩
(কালকিনি-মাদারীপুর)
তারিখ: ১১ এপ্রিল ২০১৩

জনাব মতিউর রহমান
সম্পাদক
দৈনিক প্রথম আলো
কাওরান বাজার, ঢাকা।

শ্রদ্ধেয় মতি ভাই,
আসসালামু আলাইকুম। বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাই। আগামী পুরো বছরটি আপনার জীবনে অনাবিল সুখ ও শান্তি বয়ে আনুক-এ কামনা করি।

গত ১০.০৪.১৩ খ্রি. তারিখে বরিশালে যাাত্রীসহ একটি বাস-দুর্ঘটনার খবর দেশবাসীকে হতবাক করেছে, আমাকে ব্যথিত করেছে।

আমাকে বিস্মিত করেছে, যখন আমি দেখেছি, এ ধরনের একটি দুর্ঘটনার খবর, একটি বাসযাত্রী নিয়ে পানিতে পড়ে যাওয়ার খবর, ৩০/৩৫ জন লোক নিখোঁজ হওয়ার খবর বিভিন্ন পত্রিকায় গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করলেও, আপনার সম্পাদিত পত্রিকা প্রথম আলোতে এ মর্মান্তিক দুর্ঘটনা নাড়া দিতে পারেনি।

এ দুর্ঘটনার কোন খবরই আপনার পত্রিকায় পরের দিন প্রকাশিত হয়নি। অথচ এই প্রথম আলো পত্রিকা, আমি যোগাযোগমন্ত্রী থাকাকালে, যে-কোনো দুর্ঘটনার দায়ভার আমার উপর চাপিয়ে আনন্দ পেত। বড় বড় হেডলাইনে খবর ছাপা হতো। সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয় লেখা হয়েছে।

কার্টুন ছেপেছে। আজকে সেই দিনকার প্রথম আলোর ভূমিকা কোথায়? পত্রিকার পাতায় কেন বরিশালের মর্মান্তিক বাস দুর্ঘটনার নিউজ পাওয়া যায় না? অথচ আপনার পত্রিকায় আমাকে অনাহুতভাবে নানা ঘটনায় জড়িয়ে আমার বিরুদ্ধে অসত্য নিউজ করেছে, ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে নিউজ করেছে।

আজকে কেন প্রথম আলো বরিশাল ফেরির অব্যবস্থাপনা নিয়ে লিখে না? খবর প্রকাশ করে না? প্রথম আলো পত্রিকায় বরিশালের এ দুর্ঘটনা সম্পূর্ণভাবে ব্লাকআউট। এর উদ্দেশ্য কী? আর আমি যোগাযোগমন্ত্রী থাকাকালীন সময়েই বা কী উদ্দেশ্য এত বাড়াবাড়ি করা হয়েছে?

বিষয়টি আপনাকে মুরুব্বি হিসেবে, সম্পাদক হিসেবে, আমার শ্রদ্ধেয় ভাই হিসেবে, অভিভাবক হিসেবে, সমাজের কণ্ঠস্বর হিসেবে, ভেবে দেখতে অনুরোধ করছি। উল্লেখ্য, আমার বাবা-মা, ছাত্রজীবনে আমার কোনো শিক্ষক-কখনো আমার গায়ে হাত দেননি। অথচ আপনার পত্রিকা সুযোগের অসৎ ব্যবহার করে আমার বিরুদ্ধে অসত্য সংবাদ প্রকাশ করেছে, আমাকে বিতর্কিত করেছে। আমাকে সমাজে হেয় প্রতিপন্ন করেছে।

শ্রদ্ধেয় মতি ভাই, বিশ্বের অনেক জনপ্রিয় ব্যক্তিবর্গ-বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকার আলমগীর কবির, ফরাসি বিজ্ঞানী পিয়েরে কুরি, নাইজেরিয়ার নেতা এডোগোক আদেলাবুর, ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জুসেলিনো কুরিটসেক, সোভিয়েত নেতা ম্যাসহরেভ, নভোচা পিট কনবার্ড ও প্রিন্সেস ডায়না সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেলেও সংশ্লিষ্ট দেশের সরকার বা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর কেউ পদত্যাগ চায়নি।

হৈচৈ করেনি। শিশুদের গলায় ‘পদত্যাগ চাই’ ব্যানার ঝুলায়নি। শহীদ মিনারে যায়নি। অথচ বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ, বিশিষ্ট সাংবাদিক মিশুক মুনীর দুর্ঘটনায় মারা যাবার পর শহীদ মিনারে গিয়ে যোগাযোগমন্ত্রী হিসেবে আমার পদত্যাগ চাওয়া হয়েছে।

এমনকি বাংলাদেশের একসময়ের ডাকসাইটে অর্থমন্ত্রী জনাব সাইফুর রহমানের সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর পরও বুদ্বিজীবী বা খোদ বিরোধীদল বিএনপি’র কেউ যোগাযোগমন্ত্রীর পদত্যাগ চায়নি।

শ্রদ্ধেয় মতি ভাই, আজি জানি, সড়ক দুর্ঘটনার একটি মৃত্যু একটি পরিবারকে নিঃস্ব করে দেয়। এ দুঃখবোধ ও ক্ষতি একটি পরিবারকে সারাজীবন বহন করতে হয়। তাই সড়ক দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতে আমাদের সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। সচেতনতা বাড়াতে হবে। আইনের প্রয়োগ নির্বিঘœ করতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে আন্দোলন আমার- আপনার আন্দোলন। আমাদের সবার আন্দোলন।

শ্রদ্ধেয় মতি ভাই, আমি আপনাকে শ্রদ্ধা করি। আপনাকে গুণিজন হিসেবে জানি। আপনার পত্রিকা বাংলাদেশের জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য ও পাঠকপ্রিয়, অথচ এই পত্রিকাটি আমার ব্যক্তিগত সুনাম নষ্টে যে ভূমিকা রেখেছে-তা আমাকে প্রতিনিয়ত মনে করিয়ে দেয়।

আমাকে অস্বস্তিতে ফেলে। অসত্য ও মিথ্যা খবর ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে লিখে প্রকাশ করা হয়েছেÑযা জনগণের কাছে অবিশ্বাস্য হওয়ার সুযোগ কম, যেহেতু এ পত্রিকাটি এবং এর সম্পাদক হিসেবে আপনাকে মানুষ শ্রদ্ধার চোখে দেখে।

পত্রিকাটিজনগণের চিন্তাচেতনার বাইরে গিয়ে যে ব্যক্তিবিশেষের ক্ষতিতে কাজ করার প্রবণতা বিদ্যমান-তা কেউ বুঝে না, বুঝতে চায় না। এই সত্য মিথ্যা বুঝার মাঝখানে পড়ে আমার অবস্থা অবর্ণনীয়।

শ্রদ্ধেয় মতি ভাই, বাংলাদেশ এত ছোট যে, আমরা সবাই সবাইকে চিনি, জানি। কাউকে বুঝতে হলে অনেক দূরযেতে হয় না। তাছাড়া, আপিনি আমাকে ভালো করে চেনেন। কতিপয় বিষয়ে অসত্য তথ্য দিয়ে আপনার পত্রিকা রিপোর্ট করে আমার ব্যক্তিগত ইমেজকে প্রশ্নবিদ্ধ করার অপপ্রয়াস চালিয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়ে আমি অল্পসময়ের জন্য টিসিবি’র চাকরি দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেছিলাম। পরবর্তীকালে ব্যবসার উদ্দেশ্যে চাকরি থেকে ইস্তাফা দিই। ব্যবসায়ে নিজেকে পুরোপুরি নিয়োজিত করি।

প্রথমে আমদানি-রপ্তানি এবং পরবর্তীতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানী সেক্টরে মনোযোগ দিই। ব্যবসায়ে উন্নতি লাভ করি। দুর্মূখেরা বলে, আমি নাকি চাকরি থেকে বরখাস্ত হয়েছিলাম অথচ চাকরি সংক্রান্ত সকল রেকর্ড টিসিবিতে আছে। ১/১১-এর সময় আমার চাকরি ইস্তফা না বরখাস্ত-বিষয়টি তদন্ত হয়েছে।

১/১১-এর সেই তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে, আমি স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়ে এসেছি। তাহলে এ মিথ্যা অপবাদ কেন? আমার পাসপোর্ট ব্যবহার (তদন্তে প্রমাণিত-ত্রুটি ছিল একজন কর্মকর্তার) নিয়েও পত্রিকার হৈচৈ হয়েছে। যোগাযোগমন্ত্রীর অফিস মেরামত ও নতুন গাড়ি ক্রয় নিয়েও অহেতুক অসত্য লেখা হয়েছে, কার্টুন ছাপা হয়েছে।

সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয় লেখা হয়েছে। অথচ কোনো নতুন গাড়ি কেনা হয়নি। অফিস মেরামত করেছে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। এতে ব্যয় হয়েছে ৭ লাখ টাকার মতো। অথচ কতিপয় পত্রিকা, বিশেষ করে প্রথম আলো ১ কোটি ২০ লাখ টাকা উল্লেখ করে আমাকে বিতর্কিত করেছে।

কালকিনিতে বাড়ি নির্মাণ, সড়ক মেরামত ও উন্নয়ন, সড়ক নিয়ে পত্রিকায় ব্যাপক লেখালেখি হয়েছে। আমার পদত্যাগ চাওয়া হয়েছে। অথচ এব্যাপারে মন্ত্রী হিসেবে আমার কোনো ত্রুটি ছিল না। আমি কোনো অন্যায় বা অনৈতিকতার সাথে জড়িত ছিলাম না। এসব বিষয় লিখে আপনাকে চিঠি দেয়ার পরও আমার বিরুদ্ধে আপনার পত্রিকার অসত্য লেখা বন্ধ হয়নি।

শ্রদ্ধেয় মতি ভাই, আপনি বিবেকবান লোক। জনগণের কাছে আদর্শ স্থানীয় ব্যক্তিত্ব। আমিও আপনাকে শ্রদ্ধা করি। আপনাকে আমি একটি প্রস্তাব দিতে চাই-নিশ্চয়ই সত্যের খাতিরে, সততার প্রশ্নে আপনি তা গ্রহণ করবেন?

এ যাবৎ আপনার পত্রিকায় আমার সম্পর্কে যেসব রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে-সে রিপোর্টগুলো আমরা যৌথ স্বাক্ষরে দুদকে পাঠিয়ে তদন্ত করাতে পারি। তদন্তে যদি আমি দোষী সাব্যস্ত হই, তাহলে যে-কোনো শান্তি মেনে নিতে বাধ্য থাকব।

শ্রদ্ধেয় মতি ভাই, অনেক সময় নিজেকে অপরাধী মনে হয়। জীবনে সততা, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে কাজ করেও আপনাদের সমর্থন পেলাম না। কারণ জানা নেই।

বিশ্বস্তসূত্রে জানতে পারলাম-পদ্মা সেতুর বিষয় নিয়ে কানাডার আদালতে যে শুনানি হচ্ছে, তাতে ১০০০ পৃষ্ঠার পুলিশ-রিপোর্টে বাংলাদেশে আমার বিরুদ্ধে বিভিন্ন ইস্যুতে যে রিপোর্ট প্রথম আলো, ডেইলি স্টার ও অন্যান্য পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে, তার ইংরেজি অনুবাদ সংযুক্ত হয়েছে।

কে এই রিপোর্ট ও রিপোর্টের ইংরেজি অনুবাদ যোগান দিয়েছে তা জানতে ইচ্ছে করে। আমি আপনাকে নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারি, পদ্মা সেতুতে আমি কোনো দুর্নীতি, অনিয়ম ও দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত নই। আমি সারাজীবন সততা ও নিষ্ঠার সাথে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করেছি।

শ্রদ্ধেয় মতি ভাই, বাংলাদেশে এত ব্যক্তি, ব্যবসায়ী বুদ্ধিজীবী ও গণমান্য ব্যক্তি থাকতেÑআপনার পত্রিকা আমার বিরুদ্ধে অসত্য তথ্য নিয়ে মাঠে নেমেছে কেন? আমি কি সত্যিই কোনো অন্যায় করেছি? আমি আমার মেধা ও প্রচেষ্টায় ব্যবসা করে প্রতিষ্ঠা পেয়েছি।

আমি সততার সাথে, নিষ্ঠার সাথে, প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ব্যবসা করে সৎপথে অর্থ উপার্জন করেছি। উপার্জিত অর্থের কর প্রদান করে চলেছি। তাহলে আমার অপরাধ কোথায়? আপনার কাছ থেকে আমি সৎ পরামর্শ প্রত্যাশা করি।

শ্রদ্ধেয় মতি ভাই, আমি কিছুদিন দেশের বাইরে ছিলাম। আজই দেশে ফেরেছি। বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়া (বিএফএ) বার্ষিক সম্মেলনে যোগদানের জন্য চীনে গিয়েছিলাম। আপনি জানেন, আমি বিএফএ-এর বাংলাদেশের প্রতিনিধি। ২০০১ সালে বিএফএ-র জন্মলগ্ন থেকে আমি এ ফোরামে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছি।

এ সম্মেলনে আমার চীনের নতুন প্রেসিডেন্ট শি জিংপিং এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী, যিনি আমার বন্ধু, Wang Yi-এর আলোচনা হয়েছে। এছাড়াও, অনেক দেশের সরকারপ্রধানদের সাথেও আলোচনা হয়েছে। অন্যান্য এশিয়ার রাজনৈতিক, ব্যবসায়ী নেতাদের সাথেও সাক্ষাৎ ও মতবিনিময় হয়েছে।

এ ফোরামে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির শিক্ষক নোবেল লরিয়েন্টের সাথে দেখা ও আলাপ হয়েছে। তিনি ড. ইউনূস-এর সাথে নোবেল বিজয়ী হয়েছেন।

দেশের উন্নয়নে, সত্য প্রচারে আপনার ইতিবাচক ভূমিকা প্রত্যাশা করি। আপনার সুস্বাস্থ্য ও সুন্দর জীবন কামনা করি।


গভীর শ্রদ্ধান্তে,
একান্তভাবে আপনার,
সৈয়দ আবুল হোসেন, এমপি

অনুলিপি
রোকেয়া প্রাচী
অভিনেত্রী, ঢাকা।

আরো পড়ুন

Comments to: মতিউর রহমানের কাছে সৈয়দ আবুল হোসেনের চিঠি

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    Attach images - Only PNG, JPG, JPEG and GIF are supported.

    Login

    Welcome to Chithipotro

    You are couple of steps away from being one of our family member
    Join Us