সৈয়দ আবুল হোসেন
সংসদ সদস্য
২২০, মাদারীপুর-৩
(কালকিনি-মাদারীপুর)
তারিখ: ১১ এপ্রিল ২০১৩

এডভোকেট তারানা হালিম
মাননীয় সংসদ সদস্য
এপার্টমেন্ট-এ/৩, রিজেন্সি রেডিয়েন্স
প্লট-১, সড়ক-৩৬, গুলশান-২, ঢাকা।

শ্রদ্ধেয় তারানা হালিম,
আসসালামু আলাইকুম। বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা। আগামী পুরো বছরটি আপনার জীবনে অনাবিল সুখ ও শান্তি বয়ে আনুক-এ কামনা করি।

শ্রদ্ধেয় মহোদয়া, কুমিল্লার একটি দুর্ঘটনার বিষয়কে কেন্দ্র করে আপনাকে আমি একটি চিঠি দিয়েছিলাম। আমার আশঙ্কা, আমার দুঃখবোধ, আমার অনুভূতি প্রকাশ করেছিলাম। সে চিঠির প্রেক্ষিতে আপনার একটি সুন্দর, সাবলীল সরাসরি লেখা চিঠি আজই আমি চীন থেকে ফিরে এসে পেয়েছি।

চিঠিটি আমাকে আশ্বস্ত করেছে, চিঠিটি আমাকে মুগ্ধ করেছে। আপনার অকপট ও সত্য উচ্চারণে আমি মোহিত, আমি খুশি হয়েছি। আমার লেখা চিঠিতে আমি আপনাকে সরাসরি দায়ী করিনি, দায়ী করতে চাইনি।

আমার বিরুদ্ধে প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ ও বিশিষ্ট সাংবাদিক মিশুক মুনীরের দুর্ঘটনা নিয়ে যে বাড়াবাড়ি হয়েছে, একটি সুধীমহল যে অতি বাড়াবাড়ি করেছে, তা উল্লেখ করেছি। শহীদ মিনারে নিষ্পাপ শিশুদের গলায় ‘মন্ত্রীর পদত্যাগ চাই’-ব্যানার ঝুলিয়েছে-তা কতটুকু যুক্তিযুক্ত ও সমীচীন ছিল-তা উল্লেখ করেছি।

দুর্ঘটনা নিয়ে আপনি ভাবেন, আন্দোলন করেন, সচেতনা সৃষ্টিতে কাজ করেন-সেই দৃঙ্গিভঙ্গি থেকে আপনাকে পত্র দিয়েছি, অবহিত করেছি। তবুও আপনি যদি আমার লেখায় আহত হয়ে থাকেন, কষ্ট পেয়ে থাকেন-সেজন্য দুঃখ প্রকাশ করছি।

আমি মনে করি, সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সামাজিক আন্দোলন ছাড়া, সচেতনতা বৃদ্ধি ছাড়া কোন পরিত্রাণ নেই। এই আন্দোলন গড়ে তোলা ও সচেতনতা সৃষ্টিতেই আপনি কাজ করছেন-এটা নিঃসন্দেহে ভালো উদ্যোগ।

শ্রদ্ধেয় মহোদয়া, আমি আপনাকে জানি। আমি ভেতরের তারানা হালিমকে শ্রদ্ধা করি। আপনার সত্য উচ্চারণ ও সমাজ নির্মাণের কার্যক্রমকে আমি পছন্দ করি। শুধু সমাজকর্মী হিসেবে নয়, আপনাকে সংস্কৃতিকর্মী হিসেবে আমি দীর্ঘদিন থেকে জানি।

কারণ, সংস্কৃতি, কর্মী হিসেবে আপনার অভিনয় অনেক আগে থেকেই আমাকে মুগ্ধ করে রেখেছে। আইনজ্ঞ হিসেবে, জনপ্রতিনিধি হিসেবে আপনার সুখ্যাতি, সংসদে আপনার অনবদ্য সংসদীয় ভূমিকা, আপনার উদারচেতা ও জনদরদী মন যে কোনো মানুষকে আকৃষ্ট করে। বস্তুত আমি আপনার একজন গুণমুগ্ধ ভক্ত। আপনার অব্যাহত সাফল্য কামনা করি।

শ্রদ্ধেয় মহোদয়া, আমি ব্যবসা করে জীবনে সাফল্য এনেছি। আমি তথাকথিত শক্তিশালী রাজনৈতিক কর্মী নই। আমি কুটিল ও নেতিবাচক রাজনীতি বুঝি না। এ ধরনের রাজনীতি করি না। আওয়ামী লীগকে ভালোবাসি, ছাত্রজীবন থেকেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি করেছি, জাতির জনকের কন্যা শেখ হাসিনার রাজনীতি করছি।

আওয়ামী লীগের জনগণের রাজনীতি বাস্তবায়নে এলাকার উন্নয়নে কাজ করেছি। এলাকার শিক্ষাপ্রসারে ভূমিকা পালন করেছি। নিজের পরিশ্রমলব্ধ অর্থ দিয়ে এলাকায় অসংখ্য প্রাথমিক স্কুল, মাদরাসা, উচ্চ বিদ্যালয়, কলেজ স্থাপন করেছি।

এলাকায় গুণগত শিক্ষাপ্রসারে ব্যাপক অবদান রেখেছি। একবার আমার নির্বাচনী এলাকায় সফরে গেলে উপলব্ধি করতে পারবেন-আমি কীভাবে এলাকার শিক্ষাবিস্তার করেছি। শিক্ষার উন্নয়নে কাজ করেছি। আপনাকে আমার এলাকা পরিদর্শনে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।

শ্রদ্ধেয় মহোদয়া, আমি দেশের বাইরে ছিলাম। বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়া (বিএফএ) বার্ষিক সম্মেলনে যোগদানের জন্য চীনে গিয়েছিলাম। আমি বিএফএ’র বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি। ২০০০ সালে বিএফএর জন্মলগ্ন থেকে আমি এর বাংলাদেশের প্রতিনিধি।

এ সম্মেলনে চীনের নতুন প্রেসিডেন্ট শিজিংপং এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রী, যিনি আমার বন্ধু, ইয়াৎ ওয়াংই’র সাথে আমার আলোচনা হয়েছে। অন্যান্য এশিয়ার রাজনৈতিক ও ব্যবসায়ী নেতাদের সাথেও সাক্ষাৎ ও মতবিনিময় হয়েছে।

শ্রদ্ধেয় মহোদয়া, নিজের চেষ্টা ও কর্মোদ্যোগে আমি এ পর্যায়ে এসেছি। আপনার মতো আমার আঙ্গিকে দেশ ও জনগণের সেবায় আত্মনিয়োগ করেছি। নিজের অর্থ ও শ্রম ব্যয় করে চলেছি। কিন্তু পারিপার্শ্বিকতা ও কতিপয় স্বার্থান্বেষীর কোপানলে পড়ে, কারণ জানি না, আজ আমাকে নানাভাবে বিতর্কিত করা হচ্ছে।

আমার প্রতি অন্যায় আচরণ করা হচ্ছে। একটি সড়ক দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঈদের দিন শহীদ মিনারে পর্যন্ত আমার পদত্যাগ চাওয়া হয়েছে। আসলেই আমি এক ষড়যন্ত্রের আবর্তে পড়ে আছি, আমি এক ষড়যন্ত্রের শিকার। আপনি জানেন, গতকাল বরিশালে একটি বাস দুর্ঘটনার খবর দেশবাসীকে হতবাক করেছে, আমাকে ব্যথিত করেছে।

আমাকে বিস্মিত করেছে-যখন আমি দেখি, এ ধরনের একটি দুর্ঘটনার খবর, একটি বাস যাত্রী নিয়ে পানিতে পড়ে যাওয়ার খবর, ৩০/৩৫ জন লোক নিখোঁজ হওয়ার খবর বিভিন্ন পত্রিকায় গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করলেও প্রথম আলো এবং প্রথম আলোর সম্পাদক জনাব মতিউর রহমানকে এ মর্মান্তিক সংবাদ নাড়া দিতে পারেনি।

তিনি এ দুর্ঘটনার কোনো খবরই আজ তার পত্রিকায় প্রকাশ করেননি। অথচ এই মতিউর রহমান, আমি যোগাযোগমন্ত্রী থাকাকালে, যে-কোনো দুর্ঘটনার দায়ভার আমার উপর চাপিয়ে আনন্দ পেতেন। বড় বড় হেডলাইনে খবর ছাপাতেন। সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয় লিখতেন।

আজকে তিনি কোথায়? পত্রিকার পাতায় কেন বরিশালের এতবড় দুর্ঘটনার নিউজ পাওয়া যায় না? কী জঘন্য, কুৎসিত মনের মানুষ হলে, ব্যক্তি বিদ্বেষী মানুষ হলে, সুযোগ-সন্ধানী ও লাভালাভ-সন্ধানী মানুষ হলে-এত নীচুতে নেমে আমার বিরুদ্ধে অসত্য নিউজ করতে পারেন?

আজকে কেন তিনি বরিশাল ফেরির অব্যবস্থাপনা নিয়ে লিখেন না? খবর প্রকাশ করেন না? তার পত্রিকায় বরিশালের এ দুর্ঘটনা সম্পূর্ণভাবে ব্লাকআউট। এর উদ্দেশ্য কী? আর আমার সময়েই বা কী উদ্দেশ্যে এত বাড়াবাড়ি করা হয়েছে?

বিষয়টি আপনাকে, সামাজিক কর্মী হিসেবে, জনপ্রতিনিধি হিসেবে, সমাজের কণ্ঠস্বর হিসেবে, ভেবে দেখতে অনুরোধ করছি। আমার বাবা-মা কোনদিন আমার গায়ে হাত দেননি। অথচ এ মতিউর রহমান ব্যক্তি বিদ্বেষী ও স্বার্থান্বেষী হয়ে আমার বিরুদ্ধে অসত্য কথা লিখে আমাকে বিতর্কিত করেছেন।

শ্রদ্ধেয় মহোদয়া, আপনি জানেন, সড়ক দুর্ঘটনা পৃথিবীর প্রত্যেক দেশে একটি অনিবার্য আতঙ্ক। ইতিহাস বলে শুধু উন্নয়নশীল দেশ নয়, উন্নত দেশেও সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। আমেরিকা, ফ্রান্স, লন্ডন, জাপান, সিঙ্গাপুরের মতো উন্নত দেশ হতে শুরু করে বাংলাদেশের মতো এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার উন্নয়নশীল দেশগুলোও সড়ক দুুর্ঘটনা হতে মুক্ত নয়।

বরং জনসংখ্যা, যানবাহন ও আধুনিক অবকাঠামো বিবেচনায় উন্নয়নশীল দেশে সড়ক দুর্ঘটনার তুলনামূলক ভয়াবহতা উন্নত দেশের তুলনায় তেমন ভয়ংকর নয়। অতীতের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যাবে, পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ানক সড়ক দুর্ঘটনাগুলোর অধিকাংশই উন্নত বিশ্বে ঘটছে।

এক হিসেবে দেখা যায়, ১৮৫০ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনায় সারাবিশ্বে ২১৩০ জন বিখ্যাত ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। এদের ৭০ ভাগই ঘটেছে উন্নত দেশসমূহে। যদিও বিখ্যাতদের সংজ্ঞা এখানে দেয়া হয়নি। তবে তালিকা দেখে বুঝা যায়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিতদের বিখ্যাত বুঝানো হয়েছে।

শ্রদ্ধেয় মহোদয়া, ২১৩০ জন বিখ্যাত ব্যক্তির মধ্যে কেবল কয়েকজনের নাম উল্লেখ করা যায়-এদের অনেকে সুবিজ্ঞ পাঠকের কাছে পরিচিত।

দুর্ঘটনায় নিহত এ সকল বিখ্যাতদের মধ্যে রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান, রাজনীতিবিদ, নোবেল পুরস্কার বিজয়ী, দার্শনিক, স্থপতি, প্রকৌশলী, খেলোয়াড়, কবি-সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, গণিতজ্ঞ, গায়ক, লেখক, দার্শনিক, চিত্রশিল্পী, অভিনেতা-অভিনেত্রী, চলচ্চিত্র পরিচালক, রেসলার, অ্যাথেলেট, সাংবাদিক, শিক্ষক, অর্থনীতিবিদ ও নভোচারীসহ আরও অনেক পেশার ব্যক্তিরা রয়েছেন।

আমাদের বাংলাদেশেও অনেক বিখ্যাত লোক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন। ১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দের ২০ জানুয়ারি প্রখ্যাত চলচিত্রকার আলমগীর কবির সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। বিশ্বখ্যাত ফরাসি বিজ্ঞানী ও নোবেল পুরস্কার বিজয়ী পিয়েরে কুরি ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন।

নাইজেরিয়ার নেতা এডোগোক আদেলাবুর ১৯৫৮ সালে ৪৩ বছর বয়সে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। সোভিয়েত নেতা ম্যাসহরেড ১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। যুগোশ্লাভিয়ার প্রিন্স ক্রিস্টোফার ১৯৯৯ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন। নভোচারী পিট কনরার্ড সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিলেন। প্রিন্স ডায়নাও মারা গিয়েছেন সড়ক দুর্ঘটনায়।

শ্রদ্ধেয় মহোদয়া, পৃথিবীর এত জনপ্রিয় ব্যক্তিরা সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেলেও সংশ্লিষ্ট দেশের সরকার বা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর কেউ পদত্যাগ চায়নি। হৈ চৈ করেনি। শিশুদের গলায়পদত্যাগ চাইব্যানার ঝুলায়নি। শহীদ মিনারে যায়নি।

এমনকি বাংলাদেশের একসময়ের ডাকসাইটে অর্থমন্ত্রী জনাব সাইফুর রহমানের সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর পরও বুদ্ধিজীবী বা খোদ বিরোধীদলের কেউ যোগাযোগমন্ত্রীর পদত্যাগ চায়নি।

শ্রদ্ধেয় মহোদয়া, আপনি আপনার পত্রে আপনার বোনের ছেলের দুর্ঘটনার কথা লিখেছেন। ওর ছবি বুকে নিয়ে মানববন্ধনের কথা বলেছেন। আপনার আবেগের এই জায়গাটিতে আমি সমব্যথী।

আপনি জানেন কিনা জানি না-আপনার বোনের ছেলে ও তার পরিবার আমার কত আপন। কত কাছের। তারা আমার পরমআত্মীয়। এ পরিবার আমার কী রকম আত্মীয় তা আপনার বোন ও ভগ্নীপতির কাছ থেকে জানতে পারবেন।

শ্রদ্ধেয় মহোদয়া, আমি জানি, সড়ক দুর্ঘটনার একটি মৃত্যু একটি পরিবারকে নিঃস্ব করে দেয়। এ দুঃখবোধ ও ক্ষতি একটি পরিবারকে সারাজীবন বহন করতে হয়। তাই সড়ক দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতে আমাদের সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। সচেতনতা বাড়াতে হবে।

আইনের প্রয়োগ নির্বিঘ্ন করতে হবে। আপনি এ আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত। এ আন্দোলন আমারও আন্দোলন, আমাদের সবার আন্দোলন। এ আন্দোলনে আমার সহযোগিতা ও একাত্মতা আপনাদের সাথে রয়েছে।

আপনার সংগ্রামের অব্যাহত সাফল্য কামনা করি। আপনার সুস্বাস্থ্য ও সুন্দর জীবন কামনায়-

গভীর শ্রদ্ধান্তে,
একান্তভাবে আপনার,
সৈয়দ আবুল হোসেন, এমপি

আরো পড়ুন

Comments to: এডভোকেট তারানা হালিমের কাছে সৈয়দ আবুল হোসেনের চিঠি

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    Attach images - Only PNG, JPG, JPEG and GIF are supported.

    Login

    Welcome to Chithipotro

    You are couple of steps away from being one of our family member
    Join Us