সৈয়দ আবুল হোসেন
সংসদ সদস্য
২২০, মাদারীপুর-৩
(কালকিনি-মাদারীপুর)
তারিখ: ২৩ ডিসেম্বর ২০১২
জনাব কাজী সিরাজ
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
ঢাকা।
শ্রদ্ধেয় মহোদয়,
আসসালামু আলাইকুম।
২৩ ডিসেম্বর ২০১২ তারিখে দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিনে খোলা কলামে আপনার বর্ণনামূলক বক্তব্য পড়লাম। বক্তব্যটি রাজনৈতিক ইঙ্গিতপূর্ণ, বিরোধীদল রাজনীতির খাতিরে যা বলছে তার হুবহু বর্ণনা।
পুরো বক্তব্যটি সত্যের অপলাপ, মনের মাধুরী মেশানো এবং আমাকে হেয় প্রতিপন্ন ও কটাক্ষ করে লেখা। এর আগেও আপনাকে চিঠি দিয়েছিলাম। আপনি একজন সুশিক্ষিত সুবিবেচনাপ্রসূত ব্যক্তিত্ব। দেশের একজন প্রথিতযশা সাংবাদিক।
সত্য ও মানবিকতা প্রতিষ্ঠায় একজন দুর্জয় সৈনিক। একজন বিজ্ঞজন। একজন অভিভাবক। দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি সম্পর্কে আপনি পরিপূর্ণ ওয়াকেবহাল। বিশ্বব্যাংক এবং এর কাজকর্মের পদ্ধতি সম্পর্কেও আপনি ভালো জানেন।
কতিপয় স্বার্থান্বেষীর অসত্য ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অভিযোগ আমলে নিয়ে যে অনিয়মের আশঙ্কার কথা বিশ্বব্যাংক বলেছে, তা কল্পনাপ্রসূত ও তথ্য- বিবর্জিত। এর আলোকে আপনার লেখা যখন রাজনীতিক ইঙ্গিতপূর্ণ হয়, তখন তা কোটারি হয়ে যায়।
আপনার মতো সুধীজন থেকে লেখার প্রতিটি অক্ষর সত্যাশ্রয়ী হওয়া বাঞ্ছনীয়। সত্যের অনুসারী হিসেবে লেখার আগে আপনার এদিকটি ভেবে দেখা দরকার বলে আমি মনে করি।
শ্রদ্ধেয় মহোদয়, আপনার লেখার প্রথমাংশে পদ্মা সেতুর নির্মাণ প্রস্তুতি, দাতাদের সাথে চুক্তি স্বাক্ষরের কথা লিখেছেন। একটু ভাবুন, এ চুক্তি স্বাক্ষর কি এমনি এমনি সম্ভব হয়েছে! আমি সততা ও নিষ্ঠার সাথে দ্রুততার সাথে কাজ করেছি বলেই অতি অল্প সময়ে প্রস্তুতিমূলক কাজ শেষ করেছি।
বিশ্বব্যাংক ও দাতা সংস্থার কাছ থেকে আমি সহযোগিতা পেয়েছি। ভূমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসন কাজ দ্রুত সম্পাদন করেছি। এ কাজ নিয়ে দুর্নীতির কোনো অভিযোগ উঠেনি। দাতা সংস্থাগুলোকে একত্রিত করে ঋণচুক্তি স্বাক্ষর করেছি।
পাশাপাশি মূল সেতু নির্মাণ ও পরামর্শক নিয়োগের বিষয়টি চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে এসেছি। যে কাজ করতে ‘বঙ্গবন্ধু সেতু’র ক্ষেত্রে ১০ বছর লেগেছে, মাত্র ২ বছরে পদ্মা সেতুর ততটুকু কাজ সমাপ্ত করেছি। মূল সেতুর দরদাতা নির্বাচন চূড়ান্ত পর্যায়ে ছিল-শুধু বিশ্বব্যাংকের অনুমোদনের অপেক্ষা।
আপনি জানেন, মূল সেতুর দরদাতা নির্বাচন কলমের এক খোঁচায় হয়নি। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পর্যায়ে বিশ্বব্যাংকের কনফারেন্স নেয়ার মাধ্যমে চূড়ান্ত দরদাতা নির্বাচন অনুমোদন বিশ্বব্যাংকের অফিসে পৌঁছে। এ প্রক্রিয়ায় বিশ্বব্যাংকের লোকাল অফিস ও হেড কোয়ার্টারের অনুমোদন ছিল।
একটি পর্যায়ে তাদের আপত্তি মিটিয়ে, পরামর্শ মোতাবেক পরবর্তী ধাপে অগ্রসর হওয়া গেছে। দ্বিতীয়ত, পরামর্শক নিয়োগেও একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়েছে। সচিব পর্যায়ে বিভিন্ন কমিটি গঠন বা ভাঙার যে অভিযোগ-তাও সত্য নয়। পরামর্শক তদারকি নিয়োগে অধিকতর স্বচ্ছতা আনার লক্ষ্যেই বিশ্বব্যাংকের পরামর্শ ও অনুমোদন নিয়ে কমিটি পুনর্গঠন করা হয়েছে।
প্রতিটি পর্যায়ে বিশ্বব্যাংকের তদারকি স্পষ্ট ছিল। বিশ্বব্যাংকের পরামর্শক অনুযায়ী ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীর নেতৃত্বে টিইসি কাজ করেছে। এতে আমার কোনো সংশ্লিষ্টতার প্রশ্ন অবান্তর। পরামর্শক নিয়োগের চূড়ান্ত পর্যায়ে বিশ্বব্যাংকের হঠাৎ করে ‘দুর্নীতির আশঙ্কা’ প্রকাশ অসৎ উদ্দেশ্য বলে কি আপনার কাছে মনে হয় না?
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দাতাদের সাথে কাজ করার, প্রকল্প বাস্তবায়নের যে অনুসৃত নীতি তা অক্ষরে অক্ষরে পালনের পর কোনো দুর্নীতির আশঙ্কা থাকে কি? যদি কোন আপত্তি তাদের থাকত- বিশ্বব্যাংক প্রথমদিকে বা মধ্যমস্তরে বা চূড়ান্ত অনুমোদনের আগে তা উত্থাপন করে সমাধা করা কি যেত না? আসলে এটা একটা বাহানা ছাড়া আর কিছু নয়।
শ্রদ্ধেয় মহোদয়, পদ্মা সেতু নির্মাণের কোনোন স্তরে কোনো দুর্নীতি হয়নি। আমি কোনো ধরনের দুর্নীতির সাথে সম্পৃক্ত সেই। আমি সততা ও নিষ্ঠার সাথে বাংলাদেশের জনগণের স্বপ-পদ্মা সেতুর বাস্তবায়নে কাজ করেছি। একটি দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে আমি সফল হতে পারিনি- এই দুঃখ আমার চিরকাল থাকবে।
শ্রদ্ধেয় মহোদয়, আমি বিস্মিত হই, যখন আপনার মতো বিবেকবান, সুশিক্ষিত ও আন্তর্জাতিক কূটচাল-বোঝা ব্যক্তিত্ব ‘চিলে কান গেছে’ এ-ধরনের উচ্চারণের তা পিছনে দৌড়ান, তা বিশ্বাস করেন। বিশ্বব্যাংকের বক্তব্যকে, উদ্দেশ্যমূলক বাক্যকে অমোঘ সত্য বলে মেনে নেন।
আমি সারাজীবন সততার সাথে কাজ করেছি। যেভাবে নেতিবাচকভাবে আমাকে আপনার লেখায় চিহ্নিত করেছেন- বলুন, আমি কোথায়, কার কাছ থেকে অবৈধভাবে অর্থ নিয়েছি। দুর্নীতি করেছি। পৃথিবীর এমন কোনো ব্যক্তি নেই যিনি বলতে পারবেন আমি কারো কাছে অবৈধভাবে অর্থ চেয়েছি।
আমি বলতে চাই, বিশ্বব্যাংকের অসত্য অভিযোগ ও কতিপয় পত্র-পত্রিকার উদ্দেশ্যমূলক লেখায় উদ্বুদ্ধ না হয়ে, আপনি নিজের বুদ্ধিমত্তা, নিজের দক্ষতায়, নিজের গুণে বিষয়টি জেনে আমার সম্পর্কে মন্তব্য করুন।
দেখবেন-আমি জীবনে কোনো অন্যায় করিনি। শুধুমাত্র একবার আমার এক ব্যক্তিগত কর্মকর্তার ভুলের কারণে ১৯৯৮ সালে পাসপোর্ট সংক্রান্ত জটিলতা সৃষ্টি হয়েছিল। সে ঘটনায় গণতন্ত্রের প্রতি আনুগত্যের কারণে আমি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেছিলাম।
এ পদত্যাগ ছিল একটা দৃষ্টান্ত। কিন্তু এজন্য আপনারা আমার কোনো প্রশংসা করেননি। সেই একটি বিষয় নিয়ে আপনারা আমাকে বিতর্কিত করবেন-এটা কেমন কথা? এটা কেমন বিচার, কেমন মূল্যায়ন?
শ্রদ্ধেয় মহোদয়, পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্র নিয়ে যে অভিযোগ আমার বিরুদ্ধে তোলা হয়েছে, তা অসত্য তথ্যের ওপর ভিত্তি করে। দুদক দীর্ঘ সময় এতে আমার সম্পৃক্ততা খুঁজে অনুসন্ধান চালিয়েছে।
কিন্তু তারাও সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ আনতে পারেনি বা এ প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের সঙ্গে আমার সম্পৃক্ততা পায়নি। মূল সেতু নির্মাণে আমার সম্পৃক্ততা না পেয়ে দুদক তা নথিভুক্ত করেছে। বিশ্বব্যাংকও এ তদন্তে ঐক্যমত পোষণ করেছে।
পরবর্তীতে পরামর্শক নিয়োগে দুদক তদন্ত করেছে। দুদক এক্ষেত্রে একটি মামলা করেছে। সেখানে আমাকে আসামি করা হয়নি। আমার জানামতে, বিশ্বব্যাংকও রেফারাল চিঠি ছাড়া সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ আমার বিরুদ্ধে দেয়নি, কোনো ঊারফবহপব দিতে পারেনি।
কোনো রেফারাল চিঠি কি দুর্নীতি প্রমাণ করে? এ রেফারাল চিঠি অসত্য অভিযোগের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা। দুদক যদি এ ঘটনার আরও গভীরে গিয়ে তদন্ত করে, তাহলেই আমার অবস্থান পরিষ্কার হয়ে যাবে। দুদক যদি কাউকে বা কোনো প্রতিষ্ঠানকে খুশি করার চেষ্টা না করে, তাহলে অবশ্যই আমি সম্পূর্ণ নির্দোষ প্রমাণিত হব- ইনশাল্লাহ।
শ্রদ্ধেয় মহোদয়, কাউকে আবেগ দিয়ে দোষারোপ করা অন্যায়। পদ্মা সেতুর বাস্তবায়ন না-হওয়ার দুঃখবোধ এবং সর্বোপরি, সুষ্ঠু ও পরিকল্পিতভাবে উত্থাপিত অভিযোগ আমলে নিয়ে আমাকে দোষারোপ করা উচিত হবে না।
আমি একজন সত্যনিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব হিসেবে সামগ্রিক কার্যকলাপ, পদ্মা সেতুর বাস্তবায়ন কার্যক্রম বিশ্বব্যাংকের অংশগ্রহণ ফলোআপ করে সত্যিকার ঘটনা উদ্ঘাটন করুন। দেখুন, আমাকে যেভাবে বিতর্কিত করা হচ্ছে; তাতে আমি সম্পৃক্ত কিনা?
রাষ্ট্রীয় স্বার্থে দাতাসংস্থা সম্পর্কে অনেক কথাই বলা যায় না; দাতাসংস্থা দায়মুক্তির সুযোগে অনেক কিছু বলতে পারেন, করতে পারেন। সত্যের খাতিরেই আপনার সত্যের পাশে দাঁড়ানো আইনি ও মানবিক বাধ্যবাধকতা। আমি আপনার মনের, সত্যের সে বাধ্যবাধকতার প্রকাশ কামনা করি।
আপনার সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করি।
গভীর শ্রদ্ধান্তে,
একান্তভাবে আপনার,
সৈয়দ আবুল হোসেন, এমপি
আরো পড়ুন
- প্রথম আলো সম্পাদকের কাছে সৈয়দ আবুল হোসেনের চিঠি
- প্রথম আলো সম্পাদকের কাছে সৈয়দ আবুল হোসেনের চিঠি-০২
- আমার দেশ সম্পাদকের কাছে সৈয়দ আবুল হোসেনের চিঠি
- ওবায়দুল কাদেরের কাছে সৈয়দ আবুল হোসেনের চিঠি
- প্রথম আলো সম্পাদকের কাছে সৈয়দ আবুল হোসেনের চিঠি-০৩
- অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবালের কাছে সৈয়দ আবুল হোসেনের খোলা চিঠি
- আকিদুল ইসলামের কাছে সৈয়দ আবুল হোসেনের চিঠি
- বদরুদ্দীন উমরের কাছে সৈয়দ আবুল হোসেনের চিঠি
- প্রথম আলো সম্পাদকের কাছে সৈয়দ আবুল হোসেনের চিঠি-০৪
- বাংলাদেশ প্রতিদিনের সম্পাদকের কাছে সৈয়দ আবুল হেসেনের চিঠি
- ড. ইফতেখারুজ্জামানের কাছে সৈয়দ আবুল হোসেনের চিঠি
- হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের কাছে সৈয়দ আবুল হোসেনের চিঠি
- প্রথম আলো সম্পাদকের কাছে সৈয়দ আবুল হোসেনের চিঠি-০৫
- ড. কামাল হোসেনের কাছে সৈয়দ আবুল হোসেনের চিঠি
No Comments
Leave a comment Cancel