প্রিয়তমেষু,
এখন গভীর রাত। চারপাশটা ক্রমশ শব্দহীন হয়ে আসছে। পৃথিবী জুড়ে নেমে এসেছে ঘন অন্ধকার। এমন সময় ঘুমানোটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমার চোখে ঘুম নেই। ঘুম আসার কথাও না। বাবু অঘোরে ঘুমাচ্ছে। আমি সর্ন্তপনে দরোজা খুলে বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। গ্রিলে মুখ রেখে যেটুকু আকাশ দেখা যায়, সেখানে সেই তারাটি খুঁজলাম, যে তারাটিকে ছেলে বাবা বলে জানে। কিন্তু পেলাম না। কি করে পাব বলো তো, মিথ্যে প্রবোধে ছেলেকে হয়তো ভুলানো যায়। মাকে তো নয়।
আচ্ছা, ঠিক এখন তুমি কোথায় আছো? কেমন আছো? জানবার কোনও উপায়ই তো নেই আমার! কারণ যাবার সময় তুমি কোনও ঠিকানাই রেখে যাওনি! আমি ভেবে পাই না এতটা দায়িত্ব- জ্ঞানহীন তুমি কি করে হলে! তুমি একবারও ভাবলে না, একা থেকে থেকে হাঁপিয়ে উঠলে আমি তোমায় খুঁজব! আমি কি অবুঝ শিশু যে দূর আকাশের তারাটিকেই নিজের বলে ভাবব? যাকে হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করা যায় না, চাইলে ছুঁয়ে থাকা যায় না, সে আবার আমার হয় কী করে! তোমার কি মনে আছে আজকের রাতই ছিল আমার সঙ্গে জীবিত তোমার শেষ রাত?

আরো পড়ুন রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে লেখা তসলিমা নাসরিনের চিঠি

সে রাতেও খুব গরম পড়েছিল। আর তখন তো আমাদের ঘরে এসি ছিল না। গরমে আমার কেবলি ঘুম পাচ্ছিল। বাবুকে ঘুম পাড়াতে গিয়ে আমিও ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু তুমি জেগে ছিলে। আমায় ডাকছিলে। কিছু হয়তো বলতে চেয়েছিলে। কিন্তু আমি কিছুতেই চোখ খুলে রাখতে পারছিলাম না। তোমার কেন ঘুম আসছিল না? পরের রাতেই অনন্ত ঘুমের দেশে চলে যাবে বলে? আর আমি সারাজীবনের ঘুম বোধকরি ঐ রাতেই ঘুমিয়েছি।

এখন আমার ঠান্ডা ঘরেও ঘুম আসে না। আধো ঘুম আধো জাগরণে কেটে যায় শীত- গ্রীষ্মের রাতগুলো। আচ্ছা এখন তুমি যেখানে থাকো সেখানে কি প্রচণ্ড গরম? না শীত? সেখানকার আকাশে কি মেঘ জমে? বৃষ্টি হয়? তোমার মনে আছে, বিয়ের পর আমরা যখন ছ’তলার ছাদের ওপর দুই কামড়ার একটা বাসা নিলাম, ছাদে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখব বলে?

জ্যোৎস্নারাতে দুজন পাশাপাশি বসে চাঁদ দেখব বলে দুটো প্লাস্টিকের চেয়ার কিনতে আমাদের দুই মাস অপেক্ষা করতে হয়েছিল। আমাদের টাকা ছিল না। কিন্তু স্বপ্ন ছিল অনেক। এখন কি মনে হয় জানো, আমাদের যদি আর অল্প কিছু টাকা বেশি থাকত, তাহলে আমাদের জীবনের দুটো মাস আমরা পাশাপাশি বসা থেকে বঞ্চিত হতাম না! জানো, বাবু বড়ো হচ্ছে। একটু একটু করে ওর নিজের জগৎ তৈরি হচ্ছে। ধীরে ধীরে সেখানে আমার প্রবেশাধিকার কমতে থাকবে। তা হোক। তাতে আমার কোনও আপত্তি নেই।

আমি এখন একা থাকতে শিখে গেছি। যে দিন তুমি আমায় কিছুই না বুঝতে দিয়ে চোখ বন্ধ করলে, আমি সেদিনই মনে মনে বলেছিলাম, আমি তোমায় ছেড়ে দিলাম! যে বাঁশির সুরে তুমি ঘর ছাড়লে, ঘরের মানুষ ছাড়লে, সে সুরের আবেশে তুমি সুখেই থেকো অমৃতধামে। ভেবো না, ডাক পড়লে আমিও আসব সব ফেলে! তোমার টানে।

তোমার মোনা।
৩০. ০৪. ২১
কল্যাণপুর, ঢাকা।

লেখা: লাবণ্য লিপি

Comments to: আকাশের ঠিকানায় চিঠি!

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    Attach images - Only PNG, JPG, JPEG and GIF are supported.

    Login

    Welcome to Chithipotro

    You are couple of steps away from being one of our family member
    Join Us