তনু,
তোমাকে কত কথা লিখবার ছিল। এই কুড়িটা বছরে বলবার মত কম কথাও তো জমেনি আমাদের। ভাবতে পারো তনু? কুড়িটা বছর। আমরা দুজন দুজনেকে ছাড়া। কি করে কাটিয়ে দিলাম এখন ভাবতে বসলে নিজেই তল খুঁজে পাই না।

অথচ রোজ সকালে তুমি শুভ সকাল না বললে আমার ঘুমই ভাঙত না। তোমার ভরাট গলার স্বর আমার সকালের প্রার্থনাদের জাগিয়ে দিত৷ তুমি জানতেও সে কথা।

কিন্তু সেদিন সকাল থেকে তোমার কোন ফোন পাচ্ছিলাম না আমি। রাতেও কথা হল দিব্যি। অথচ সকাল থেকে ফোনের ওপাশে যান্ত্রিক সংযোগ সম্ভব নয়ের বার্তা।

কি ভাবছ? খুব ভয় পেয়েছিলাম? মোটেই না। তোমার মনে আছে তনু? আমি তোমাকে কতবার বলতাম, অত ভারি ভারি কথা লিখবার তোমার কোন দরকার নেই৷ কি দায় অত তোমার? কেন লেখ ওসব?

আমার ভয়ে শুকিয়ে যাওয়া মুখটার দিকে তাকিয়ে তুমি হাসতে হাসতে বলতে, মিথ্যা ভয় তোমার। আমি তো সাদা কাগজে কালো কালির অস্ত্র চালাই। মুক্তমনে লিখি। খোলা লিখা আমাদের অধিকার। এইটুকু অধিকার ফলাবার দায়ে আমায় অন্তত কেউ মৃত্যুদণ্ড দেবে না৷

আমি তোমার কথা গুলোকে বিশ্বাস করেছিলাম। মনে হয়েছিল ব্লগ লিখাকে অন্তত রাজনীতি বলা চলে না নিশ্চয়ই। আর রাজনীতির বাইরে একজন সামান্য বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রের এইসব মুক্তমনের লেখাকে সত্যিই বোধহয় কেউ অতটা আমলে নেবে না।

তাই সেদিন তোমার ফোনটা বেলা বারোটা অব্ধি বন্ধ পেয়েও ভয় হয়নি আমার একটুও৷ রাগ হচ্ছিল খুব তোমার উপর। আচ্ছা তনু, তুমি একবারও বুঝতে পারোনি না? যে ওরা তোমাকে মেরে ফেলবার চক্রান্ত করেছে?

ওরা তোমাকে ডেকে নিয়ে যাবার আগে একটুও কিছু টের পাওনি তুমি? টের পেলে কি অন্তত একবার আমায় একটা ফোন করতে না বল? অত ভোরে তোমার ফোন পেয়ে আমি নিশ্চয়ই ধরমর করে উঠে বসতাম। ঘুম গলায় জানতে চাইতাম, “সারা রাত ঘুমাওনি নিশ্চয়ই? কবিতা লিখেছ? শুনি কেমন লিখলে।”

তুমি তখন কি বলতে? তুমি কি বলতে, এটাই আমাদের শেষ কথা? তুমি কি বলতে, ভালো থেকো সূর্যমুখী? কিংবা বলতে, ওই কথাটা? ওই যে রুদ্রের কবিতার বইয়ে যেমন লিখে দিয়েছিলে, ” ভালোবাসা রেখে যাব মৃত্যুর চেয়ে বেশি।”

কিছুই তো হল না তনু৷ তোমার বন্ধুর ফোন পেয়ে ঢাকা মেডিকেল ছুটে যাবার সময়ও আমার বুকের মধ্যে টলমল করছিল অভিমান। মনে হচ্ছিল ছুটে গিয়ে তোমার বুকের উপর আছড়ে পরে বলব, বীরপুরুষ, আজ থেকে তোমার কলম শুধু আমায় নিয়ে লিখবে৷

দেশ নয়, রাজনীতি নয়, অনিয়ম কিংবা দূর্নীতি নয়। আজকের পর থেকে শুধু আমিই হব তোমার চিন্তার আধার, তোমার মগজের ফসল আর কলমের দাগ।

শহীদ মিনার পেড়িয়ে যেতেই দেখলাম তোমার বন্ধুদের মানববন্ধন বসে গেছে। তখন এপ্রিলের শুরু। তবু শহীদ বেদির পেছনে পলাশ গাছটা কি টুকটুকে লাল তখনও।

তনু, বিশ্ববিদ্যালয়ে যে বন্ধুটি তোমাকে আর আমাকে এক সাথে দেখলেই ছুটে এসে গল্প জুড়ে দিত, দেখলাম তার হাতের প্লেকার্ডটায় লেখা শান্তনুর হত্যাকারীর ফাঁসি চাই, ফাঁসি চাই।

তারপর আমার আর কিচ্ছু মনে নেই। চোখের মধ্যে ঘোর লাগা কিছু লাল পলাশ নিয়ে আমি অচেতন হয়েছিলাম। যখন জ্ঞান ফিরল তখন তোমার আর আমার দূরত্বের সীমানা মিলিয়ে গেছে ছায়াপথদের কোলের কাছে৷

তোমার মনে আছে তনু? শহরের কাঠগোলাপ গাছটায় ঝাঁকে ঝাঁকে ফুল ফুটলেই আমরা তার নিচে গিয়ে বসতাম। তুমি আমায় বলেছিলে, সূর্যমুখী এই কাঠগোলাপ গাছটা আমি তোমার নামে লিখে দিলাম।

একবার খুব অভিমান করে আমার কপালের লালটিপটা খুলে আমি ছুঁড়ে ফেলেছিলাম। তুমি সেই টিপ কুড়িয়ে নিয়ে তোমার বুক পকেটে রাখতে রাখতে বলেছিলে, “সূর্যটাকে মুঠোয় করে নিলাম, আজ থেকে তাই সূর্যমুখী, তুমিও আমার বন্ধী।”

পূর্ণিমা তোমার কি ভীষণ প্রিয় ছিল। প্রত্যেক শুক্লপক্ষে তুমি ছাদের উপর মাদুর পেতে আকাশ দেখতে। আমায় তুমি বলেছিলে, চাঁদের ওই ধার করা আলোতে নাকি বড্ড ধার। জ্যোৎস্না গায়ে মাখলেই নাকি তুমি শব্দ খুঁজে পাও৷ ছন্দ খুঁজে পাও৷

তুমি চলে যাবার পর, আমি আর কখনো আয়োজন করে পূর্ণিমা দেখিনি জানো। আমার তো শব্দের প্রয়োজন ছিল না৷ ছন্দেরও প্রয়োজন ছিল না৷ আমি তো শুধু তোমাকে চেয়েছিলাম। তোমার সাথে বাঁধতে চেয়েছিলাম গল্পগুচ্ছের ঘর।

তবু কোন কোন অশরীরী পূর্ণিমায় এক আধ ফালি আলো ঘরে ঢুকে গেলে আমি ফিসফিস করে তোমাকে ডাকি৷ তুমি কি শুনতে পাও তনু? আমি কিন্তু কোন জবাব পাই না কখনো৷

আজকাল মনে হয়, তোমাকে ওরা মেরে ফেলে হয়ত ভালোই করেছে। তোমার মনে পড়ে? আমরা দুটো পরীর মত মেয়ের স্বপ্ন দেখতাম? তুমি বেঁচে থাকলে আমাদের নিশ্চয়ই ঘর হত, পরীর মত মেয়ে দুটো জন্মাত।

কিংবা একটা ছেলে, তোমার মত তুখোড় মেধার। তুমি তাকে ন্যায় বোধ দিতে, আদর্শ দিতে, শিক্ষা দিতে। কিন্তু এসবের কোন মূল্যই তো নেই এখন আর। খামোখা কষ্ট বাড়ত আমাদের।

তার থেকে এই বেশ। যদিও এই সমাজে একা মেয়ে মানুষ টিকে থাকা একটা ভীষণ লড়াই। তবু এই লড়াইটা আমার প্রিয়৷ এই লড়াইটাই আমাকে তোমার কথা মনে করায়৷

ভালো থেকো তনু৷ তুমি যেখানেই আছো, অপেক্ষায় থেকো। একদিন ভোর ভোর এসে তোমায় পেছন থেকে শুভ সকাল বলে চমকে দেব৷ এমন একটা ভোর নিশ্চয়ই আমার জীবনেও আসবে, যে ভোরে তুমি চলে গিয়েছিলে তোমার স্বপ্ন আর বোধের অন্যপাড়ে।

ভালোবাসা নিও।

ইতি,
সূর্যমুখী।

লিখেছেন: আদ্রিতা সরকার

Comments to: তনু কেমন আছো?

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    Attach images - Only PNG, JPG, JPEG and GIF are supported.

    Login

    Welcome to Chithipotro

    You are couple of steps away from being one of our family member
    Join Us