জয়া,
শুভেচ্ছা নিও।
একদা আমরা কেউ পূর্বপরিচিত ছিলাম না। তাই স্বাভাবিকভাবেই আমাদের মাঝে শত্রুতা থাকার প্রশ্নই আসে না। কলেজের ভর্তি পরীক্ষায় অন্যদের চেয়ে ভাল করেছি বলেই তুমি আমাকে অন্য চোখে দেখা শুরু করলে।

তোমার চোখের ভাষা বুঝবার মত মেধাবী বোধ হয় ছিলাম না। তাই সহপাঠী -বন্ধুর মতো মিশতাম। হঠাৎ তুমি যখন স্বপ্নের ফেরিওয়ালা হয়ে আসলে। আমি প্রত্যাখান করেছিলাম নিজের সীমাবদ্ধতা, দারিদ্র্য আর পরিবারের প্রতি দায়িত্ববোধের যুক্তিতে।

কেননা সাধারণ এক দরিদ্র বর্গাচাষির ছেলে যে কিনা টিউশনি করে সংসার চালায়। সে তোমার মত বিত্তবানের মেয়ের জীবনসঙ্গী হতে পারে না। বড় জোর বন্ধু হতে পারে। বরাবরের মত জেদী তুমি।মানতে পারলে না কিছুতেই। তখন কি আর জানতাম এর জন্য আমাকে একদিন চড়া মাশুল গুনতে হবে?

নদীর স্রোতের মত সময় বহমান। শিক্ষার পাঠ চুকিয়ে কে যে কোথায় চলে গেলাম। এর হদিশ কারোই জানা থাকলো না।

মামা-চাচা আর ঘুষ না দিলে এখানে কোন চাকরিই পাওয়া যায় না। আমার এগুলোর কোনটাই ছিল না। তাই চাকরিও হলো না। ব্যবসা করার মত যথেষ্ট মূলধনও ছিল না।

অবশেষে জীবন শুরু করলাম NGOর চাকরি দিয়ে। ২০ বছর ধরে বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থায় সুনাম ও দক্ষতার সাথে কাজ করেছি। কিন্ত এ পেশার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো প্রজেক্টের চাকরি। চাকরির মেয়াদ আর কর্মস্থলের কোন ঠিক ঠিকানা নেই।

প্রতিনিয়ত চাকরির ভয় আর নতুন চাকরির প্রস্ততি। ঠিক এমনি একদিন একটি প্রতিষ্ঠানের আমন্ত্রণে নিয়োগ পরীক্ষা দিলাম এবং নির্বাচিত হলাম। অফিস থেকে জানানো হলো প্রতিষ্ঠানের প্রধান দেশের বাহিরে আছেন।

উনি দেশে ফিরলেই নিয়োগ পত্র পাঠিয়ে দেবেন। দিন কয়েক পর নিয়োগ পত্র পেলাম। চাকরির খবরটা যখন নিশ্চিত করলো। তখন শুধু আমি নই আমার মা, স্ত্রী এমনকি আমাদের কচি দুটি সন্তানও নফল নামাজ পড়েছে। অনেক স্বপ্নের জাল বুনলাম।

চাকরিহীন মানুষের কাছে প্রতিটি টাকা অত্যন্ত মূল্যবান। তারপরও রোজায় বাড়িতে থাকবোনা বলে মাসের সমস্ত বাজার করে দিলাম। কুড়ি হাজার টাকা সাথে নিয়ে এখানে জয়েন করলাম।

আসার সময় আমার সন্তানরা বলেছিল বাবা ঈদে তুমি ঢাকা থেকে আমাদের জন্য কেনাকাটা করবে। আর ঈদের পর আমাদেরকে ঢাকায় নিয়ে গিয়ে চিড়িয়াখানা, স্মৃতিসৌধ, শিশুপার্কসহ সব কিছু দেখাবে। আমি বললাম ঠিক আছে।

কিন্ত এ কী! জয়েন করার দিনে HR Officer বললেন “এখন আমাদের ম্যাডামের সাথে দেখা করুন। উনি আপনাকে সব বিষয়ে Orient করবেন”, বলে একটি চেম্বারে ঢুকিয়ে দিলেন। ভেতরে এত বড় বিশ্ময় অপেক্ষা করছিল। তার জন্য মোটেও প্রস্তত ছিলাম না।

কেননা সে-ই ম্যাডামই হচ্ছো তুমি। আমার প্রিয় বন্ধু। সহপাঠি। প্রথমে বিশ্মিত হলেও পরে অবশ্য খুশিই হয়েছিলাম। কিন্ত কে জানতো তোমার ভেতরে তুমি পুষে রেখেছ বহুকাল আগের ক্রোধ। তাই প্রথম দিনেই তুমি বুঝিয়েছিলে তুমি আমার বস। মেনে নিলাম কেননা এটাই পেশাদারিত্ব।

প্রতিদিন ইচ্ছে করেই অপমান আর আমি অযোগ্য এটা প্রমাণ করতে থাকলে। কুড়িদিনের মাথায় তুমি জানিয়ে দিলে “আপনার এখানে চাকরি করার দরকার নেই। যে ক’দিন কাজ করেছেন তার বেতন-ভাতা তুলে নেন।

আমি একাউন্টসকে বলে দিচ্ছি।” লজ্জা আর অপমানে মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করলো। তাড়াতাড়ি এখান থেকে পালাতে হবে। বুক ফেটে কান্না বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। দরজার কাছে আসতেই তুমি টাকা তোলার তাগাদা দিলে। কিন্ত আমি ভিক্ষুক নই। আমি সংগ্রামী মানুষ। কেউ না জানুক। তুমি ভাল করে জান।

তোমরা সমস্ত স্বপ্ন চূড়মার করলে। নিজেদের স্বার্থে। কার জন্য এত স্বার্থপরতা কিংবা টাকা কামাচ্ছো অন্যের ক্ষতি করে? আল্লাহ্ না করুন একদিন দেখবে তুমি মৃত্যুশয্যায়। আর বেশি খরচের আশংকায় তোমার প্রিয়জনরাই কাছে থাকবেনা।

তখন প্রতিটা মূহুর্ত একাকীত্বের সাথে হিসাব মেলাবে ফেলে আসা সময়ে কত স্বপ্নের হত্যাকারী ছিলে নিজে। বহু উপমা আছে। অতি সম্স্রতি বেশ কিছু বিত্তশালী ব্যক্তি করোনায় মৃত্যুর আগের অনুভূতি ভাল করে পড়ে দেখো।

যতই পশ্চিমা পোষাক পড় না কেন। অবশেষে তুমি একজন বাঙ্গালী, মুসলমান এবং একজন মা।দিনশেষে প্রিয় অবসরে নিজের কাজগুলোকে দয়া করে বিবেকের আয়নায় দেখার চেষ্টা কোরো। আমি নিশ্চিত সেখানে অপমানিত এক ব্যক্তির অশ্রুমন্ডিত মুখখানা দেখবেই দেখবে। ভাল থেকো।

ইতি
তোমার সেই লেখক
প্রকৃতই এক বোকা লোক

লিখেছেন: রবীন জাকারিয়া

Comments to: বন্ধু তুমি শত্রু তুমি

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    Attach images - Only PNG, JPG, JPEG and GIF are supported.

    Login

    Welcome to Chithipotro

    You are couple of steps away from being one of our family member
    Join Us